ছন্দে থাকলে তিনি ব্যাট হাতের শিল্পী। উইলো থেকে বের হয় হৃদয় কাড়া সব শট। হুক, পুল, ড্রাইভ, কাট, সুইপ-সব শটই আছে তূণে। মুগ্ধ হয়ে একবার ইয়ান বিশপ বলেছিলেন, ‘‘লিটনের ব্যাট মনে করিয়ে দেয় দ্য ভিঞ্চির মোনালিসাকে।’’
সেই লিটন দাসে আস্থা খুঁজছিল বাংলাদেশও। শুধু ব্যাটে নয়, তাকে বিসিবি ভাবছিল ভবিষ্যতের কান্ডারি। এজন্য বাংলাদেশের ক্রিকেট অভিধান থেকে হারিয়ে যাওয়া সহ-অধিনায়ক পদটা অনেক দিন পর ২০২২ সালে দেওয়া হয় লিটন দাসকেই।
সাকিবের ছায়া আছে, মায়া নেই
সাকিব আল হাসানের ছায়ায় থেকে লিটনকে ভবিষ্যতের অধিনায়ক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ দেয় বিসিবি। সাকিবের মেজাজ, ঔদ্ধত্য, কাটকাট কথা-সবই খুব ভালোভাবে শিখেছেন লিটন। কিন্তু সাকিবের যে দৃঢ় মানসিকতা সেটা তো আর হয়নি তার।
হাজারটা বিতর্কে নাম জড়ালেও মাঠে গিয়ে সব ঝেরে ফেলতে পারেন সাকিব। পারফর্ম করে জল ঢেলে দিতে পারেন সব বিতর্কে । লিটনের বেলায় হয়েছে উল্টো। তিনিও জড়িয়েছেন অনেক বিতর্কে। এর প্রায় সবগুলো অহেতুক। অনেকটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত। এখন সেগুলো চাপ হয়ে ব্যাটে চেপে বসেছে, তাই ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার।
ফেইসবুক ও লিটন
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্য শেষ হওয়া চট্টগ্রাম টেস্টে লিটনের ব্যর্থতার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সহকারী কোচ নিক পোথাস। লিটনের ওপর চাপটা বাইরে থেকে আসছে বলে মনে হয়েছে এই কোচের, ‘‘ঝামেলাটা হচ্ছে লিটনের ওপর চাপটা বাইরে থেকে আসছে। যদি আমরা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওর পেছনে লেগে থাকি, তাহলে হবে না।’’
ধরে নেওয়া যাক পোথাসের কথা সত্যি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চাপ বাড়াচ্ছে লিটনের ওপর। তাহলে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকা উচিত। কিন্তু তিনি নিজে বরং বেশি সক্রিয় ফেইসবুকে।
এই ব্যাটারের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেজ থেকে টেস্ট সিরিজ চলার সময়ই পোস্ট করা হয়েছে দুটি বিজ্ঞাপণ। এর একটি মানিগ্রামের, আরেকটি ঈদে আর্টিসান এর ৩০ শতাংশ ছাড়ে পাঞ্জাবি বিক্রির। ফেইসবুকে বিজ্ঞাপণ প্রচার করে টাকা কামাবেন, আবার খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য সেই ফেইসবুকের সমালোচনা নিতে পারবেন না -দুটো একসঙ্গে হয় নাকি!
সাফল্য এবং অধারাবাহিকতা
২০২২ সালটা লিটনের দুর্দান্ত কেটেছে ব্যাট হাতে। সব সংস্করণ মিলিয়ে বাবর আজমের পর তার ছিল দ্বিতীয় সেরা সংগ্রহ। এরই স্বীকৃতি পান বাংলাদেশের দুটি ক্রীড়া সাংবাদিক সংগঠন বিএসপিএ ও বিএসজেএর বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়ে।
এই ছন্দটা পরে ধরে রাখতে পারেননি লিটন। অবশ্য ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার সঙ্গী অধারাবাহিকতা। এজন্য ওয়ানডেতে ৫টা সেঞ্চুরি করলেও তার গড় মাত্র ৩১.২৫। ০ রানেই আউট হয়েছেন ১৪বার! চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জোড়া ০ করে বাদ পড়েন তৃতীয় ওয়ানডে থেকে।
শুধু একাদশ নয়, দল থেকেই বাদ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে সিরিজ চলাকালীন যা বিরল ঘটনা। এরপর টেস্টে ফিরলেও প্রথম ম্যাচে সমালোচনার জন্ম দেন দলের দুঃসময়ে প্রথম বলে ডাউন দ্য ট্র্যাকে মারতে গিয়ে আউট হয়ে। বিসিবি সভাপতি ও ক্রীড়া মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন বিরক্তি নিয়েই বলেছিলেন, ‘‘ওর বিশ্রাম দরকার ছিল। এখনই ফেরানোটা ঠিক হয়নি।’’
সেই সমালোচনা পেছনে ফেলার সুযোগ ছিল চট্টগ্রামের ব্যাটিং উদ্যানে। সেখানে দুই ইনিংসে আউট হয়েছেন বাজেভাবে। এভাবে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসেন বলেই এই ব্যটার দলে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ ৪১ টেস্ট খেলে ফেলেছেন, ৩ সেঞ্চুরি ও ১৬ ফিফটিতে তার গড় ৩৫.১৫।
অধারাবাহিক লিটনকে নিয়ে ব্যঙ্গ
এবারের বিপিএলে লিটন দাস করেছিলেন তৃতীয় সেরা ৩৯১ রান। গড় ছিল ২৭.৯২। অথচ সেরা ছয়ে থাকা বাকি ৫ ব্যাটারের গড়ই ৩১-এর বেশি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তার গড় কেবল ২৩.৭০।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় ভয়াবহ খারাপ ফর্ম চলছিল তার। এতটাই খারাপ যে বিশ্বকাপ চলাকালীন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রন্থিক ডটকম ঘোষণা দেয়, ‘‘ম্যাচে লিটন যত রান করবে তত শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে।’’
কী সাংঘাতিক কান্ড, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও বুঝে ফেলেছিল লিটনের চূড়ান্ত অধারাবাহিক ব্যাটিং। তাই এমন দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিল তারা।
ব্যাটে না পারলেও মুখে বেশ
গত বছর বিশ্বকাপের আগে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের পর হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। দীর্ঘ দিনের সহ-অধিনায়ক থাকায় ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পান লিটন দাস।
প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই হারিয়ে ফেলেন মেজাজ। তামিমের অবসর নিয়ে আফগানিস্তান সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে প্রশ্ন শুনে রেগে বলেন, ‘‘ভাই প্রেস কনফারেন্সটা কি আগামীকালকের কোনো কিছু নিয়ে হচ্ছে। যদি না হয় তাহলে লিটন দাস এখানে না থাকাই ভাল। বোর্ড প্রেসিডেন্টকে আবার ডাক দেন বা কোচকে ডাক দেন তখন এই প্রশ্ন কইরেন। আমি আগামীকালের ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে আসছি।’’
সব মিলিয়ে এভাবে অধিনায়কত্ব পাওয়াটা চাপ হয়ে গেল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর চার শব্দে দেন লিটন, ‘‘না, না, চিল আছি।’’
সে সময় খারাপ ফর্ম যাচ্ছিল এই ব্যাটারের। গড় কমছে কেন, জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘‘ফর্ম কি, ভাই? কত করলে ফর্মে থাকব, এটা একটু বলেন না! গড়? ২৫-২৬ একদম খারাপ নয়। আপনি কত চান? ৫০ করাই লাগবে প্রতি ম্যাচে!’’
লিটনের কাণ্ড
সহ-অধিনায়ক হিসেবে তামিম না থাকায় বিশ্বকাপে নেতৃত্ব পাওয়ার কথা লিটন দাসের। অথচ বিসিবি দায়িত্বে ফেরায় সাকিব আল হাসানকে। পাশাপাশি লিটন দাসকে সহ-অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে এই পদে বসায় নাজমুল হোসেন শান্তকে।
চট্টগ্রামে লিটন মিডিয়া সামলাতে পারেননি-নানা কারণের মধ্যে এটাও ছিল একটি। এজন্যই কিনা, বিশ্বকাপ চলার সময় পুনেতে সাংবাদিকদের ওপর ঝাল মেটান লিটন। পুনের কনরাড হোটেলের সিকিউরিটির কাছে অভিযোগ জানিয়ে লবি থেকে বের করে দেন সাংবাদিকদের। এতে সমালোচনার ঝড় উঠলে বাধ্য হয়ে ক্ষমা চান পরে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন ঝামেলা সেবারই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে সিলেটে বিপিএল চলার সময় এক সাংবাদিক লিটনের হাতে আঁকা ট্যুাটুতে হাত দিয়ে জানতে চান, ‘‘কোথা থেকে করিয়েছেন এটা।’’ লিটন ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে বলেছিলেন, ‘‘গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?’’ সবকিছুতেই তার প্রতিক্রিয়া একটু বেশি।
গত বছরের শুরুতে ইংল্যান্ড সিরিজের সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সম্মতি জানিয়েছিলেন লিটন। সাংবাদিকদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে পরে জানান, কথা বলবেন না তিনি। এক সাংবাদিক তখন জানতে চান,‘‘তাহলে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলেন কেন? আমরা না খেয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’’ লিটনের সটান জবাব, ‘‘তো আমি কি করব?’’
এভাবেই লিটন কারণে-অকারণে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলতে পারেন সবাইকে।
ছুটি বিলাস
গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ চলার সময় সন্তান সম্ভবা ছিলেন লিটনের স্ত্রী। এজন্য বিশ্বকাপ চলার মাঝেই দুবার ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন! দ্বিতীয়বার তার ছুটি নেওয়াটা বোর্ড মানতে না পারলেও বিশ্বকাপের কথা ভেবে কঠোর হয়নি।
বিশ্বকাপ শেষে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজে খেলতে চাননি লিটন, ছুটি চেয়ে বসেছিলেন বিসিবির কাছে। অথচ বিসিবি তার হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে চেয়েছিল। শেষমেষ বাধ্য হয়ে টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া হয় নাজমুল হোসেন শান্তকে।
লিটনকে এক মাসের ছুটি দেওয়া নিয়ে তখন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস বলেছিলেন, ‘‘কোনো ক্রিকেটার যদি নিজ থেকে বলে, ‘খেলব না বা খেলতে চাই না’, তাকে আপনি জোর করে জাতীয় দলে খেলাতে পারবেন না। জাতীয় দলে খেলার জন্য এই পেশাদারিত্বটা তার হৃদয় থেকে আসতে হবে।’’
চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টা সবসময় দ্বিপাক্ষিক হতে হয়। আপনি যখন দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসবেন না তখন বিসিবিও আপনার কথা ভাবতে বাধ্য নয়। বরং বিশ্বকাপের পর দুঃসময়ে যিনি সাহসী হয়ে এগিয়ে যাবে ক্রিকেট বোর্ডও তার পক্ষে দাঁড়াবে।
শচীন টেন্ডুলকারের মত কিংবদন্তিও বিশ্বকাপ চলার সময় বাবার মুত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সৎকার শেষে দ্রুত ফিরে গিয়ে সেঞ্চুরিও করেছেন বিশ্বকাপে। এটাই হচ্ছে দেশপ্রেম, জাতীয় দলের জন্য আত্মনিবেদন।
এমন বড় বড় খেলোয়াড়ের জীবন থেকেও শিক্ষা নেওয়া যায়। তাদের দেখেও শেখা যায়। বড় হতে গেলে বড়দেরই অনুসরণ করতে হয়। সেটা না করলে প্রতিভাবান লিটনের প্রতিভার অপচয়ই হবে। আপাতত তিনি নিজেই নিজের সমস্যা।