সিদ্ধান্ত বদল, নাটক—এটাই যেন জাতীয় পার্টি, আর তাদের রাজনীতি। ভোটের পর এবার শপথ নিয়েও হলো নাটক।
মঙ্গলবার সকালে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ‘কাল শপথ নিচ্ছি না’ বললেও বিকেলে জাপার পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বুধবার শপথ নেবে।
দলটির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহবুব আলম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘আগামীকাল (বুধবার) শপথ নেবেন জাতীয় পার্টির নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। পূর্ব ঘোষিত বৃহস্পতিবারের সভা বাতিল করা হয়েছে।’’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেও ২৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জিতেছে তারা। আর ছাড় না দেওয়া অন্য আসনগুলোতে নৌকার তোড়ে লাঙ্গল টিকতেই পারেনি।
এ নিয়ে চাপে পড়ে দলটির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা নতুন কৌশল নেয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটে জয়ীরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন বুধবার সকাল ১০টায়।
মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকদের চুন্নু বলেন, ‘‘কাল আমরা শপথ নিচ্ছি না। পরশু (বৃহস্পতিবার) সকাল ১১টায় আমরা বৈঠকে বসব।’’
‘‘জাতীয় সংসদে একাদশ জাতীয় সংসদের উপনেতা জি এম কাদেরের অফিসে এই বৈঠক হবে। বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করা হবে শপথের বিষয়টি।’’
জাপায় গুঞ্জন
নির্বাচনের পর থেকেই প্রার্থীদের চাপে রয়েছেন দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রেসিডিয়াম সদস্য সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘নির্বাচনে যাওয়াই আমাদের ভূল হয়েছে।
‘‘আমরা বারবার বললেও চেয়ারম্যান বা মহাসচিব আমাদের কথা শোনেন নাই। তাদের ভুলে এখন জাতীয় পার্টিকে মাসুল দিতে হচ্ছে।’’
কারচুপি, সিল মারা, টাকা উড়িয়ে নির্বাচন হয়েছে—এ অভিযোগ তার। ‘‘এ নির্বাচনে শপথ নিলে আমাদের আর সম্মান থাকবে না।’’
জাপার ভিতরে উঠেছে গুঞ্জন- তারা মন্ত্রিসভায় ও সংরক্ষিত মহিলা আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যা চায়। আর এজন্যই সরকারকে চাপে ফেলাতে আপাতত শপথ না নেওয়ার কৌশল তাদের।
এবারের নির্বাচনে যা পেল জাপা
এবারের নির্বাচনে জাপারে প্রার্থী ছিল ২৬৪ জন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল ২৬টি আসনে। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ২৬ সংখ্যাটিকেও চূড়ান্ত ফলে কাজে লাগাতে পারেনি জাতীয় পার্টি। ভোটে জয় পেয়েছে মাত্র ১১ জন।
তারা হলেন, দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। তারা চারজন যথাক্রমে রংপুর, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী থেকে নির্বাচনে অংশ নেন।
এর বাইরে প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), গোলাম কিবরিয়া (বরিশাল-৩), একেএম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), মো আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), একেএম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১) ও শরিফুল ইসলাম (বগুড়া-২) জয় পেয়েছেন। রুহুল আমিন হাওলাদার ও আশরাফুজ্জামান ছাড়া বাকিরা বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদেরও সদস্য।
নির্বাচনের শুরু থেকেই যত নাটক
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন রেখে কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন গত ১৫ নভেম্বর তফশিল ঘোষণা করে।
এরপর থেকে নাটকে ফেরে জাপা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাকি বাইরে থেকে—কোনভাবে নির্বাচন করবে দলটি, তা বোঝা ছিল দুষ্কর।
দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বে দলটিতে ভেতরে ভেতরে সংকট আরও বাড়ে। সেই দুর্বলতা প্রকট হয় নালিশে।
অভিযোগ নিয়ে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দেখা করেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও। গত ১২ ডিসেম্বর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপাকে যেন জোটে না নেওয়া হয়, আসনও সমঝোতাও না করে।
তবে রওশনের অনুরোধ রাখেনি আওয়ামী লীগ, সমঝোতা করে ক্ষমতাসীনরা। ২৬টি আসনে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়।
এরপর প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন গত ১৭ ডিসেম্বরও সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল জাপা।
সেদিন সকালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এইচএম এরশাদের ছোট ভাই জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বনানীর দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশের সময় সাংবাদিকদের বলেন “ভিক্ষার সিট আমি নেব না।’’
দিনভর সেই নাটক মঞ্চায়ন চলে। বিকেলে দলটি জানায় তারা ভোটে যাবে। সংবাদ সম্মেলনে সে কথা বলেন চুন্নু। অফিসে থাকা সত্ত্বেও সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন না জিএম কাদের।
আসন সমঝোতা নিয়ে ক্ষোভ ছিল জাপা নেতাকর্মীদের। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে একে একে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে থাকে দলটির প্রার্থীরা। ভোটের দিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নির্বাচন বর্জন করে ১১ প্রার্থী।
ভোট নিয়েও ভিন্নমত ছিল জাপা নেতাকর্মীদের মধ্যে। ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে কি না— প্রশ্নে জিএম কাদের সমালোচনা করলেও কৌশলী বক্তব্য দেন চুন্নু।