ব্যবসায়ী, সাংসদ, ফুটবলার- এই তিনের মধ্যে অবধারিতভাবেই শেষের পরিচয়ে গর্ববোধ করেন আবদুস সালাম মুর্শেদী। খুলনা থেকে ফুটবল খেলতে ঢাকায় আসা সালাম মুর্শেদীর আজকের পরিচয়ের ভিত তো অনেক আগেই গড়ে দিয়েছে তার ফুটবল ক্যারিয়ার।
গত রবিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও জয়ী হয়েছেন সালাম মুর্শেদী। নৌকা প্রতীক নিয়ে খুলনা-২ আসনে জিতেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সিনিয়র সহ-সভাপতি।
শুধু সালাম মুর্শেদীই নন, এবারের সংসদ নির্বাচনে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক ব্যক্তিত্বই জয়ী হয়েছেন। প্রথমবার অংশ নিয়ে মাগুরা-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। নড়াইল-২ আসন থেকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌপরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জিতেছেন দিনাজপুর-২ আসন থেকে। অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন।
বাফুফের সহ-সভাপতি ও আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল আহমেদ জয় পেয়েছেন যশোর-৩ আসনে। রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জিতেছেন জামালপুর-৫ আসনে।
কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান মাদারীপুর-২, ক্যারম ফেডারেশনের সভাপতি এবং তথ্য, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নাটোর-৩, শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের সাবেক সহসভাপতি ফজলে করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম-৬, বাফুফের কাউন্সিলর নিজাম হাজারী ফেনী-২ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
সাবেক শুটার শিবলী সাদিক দিনাজপুর-৬, বিওএর সাবেক সহসভাপতি ও স্কোয়াশ ফেডারেশনের সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এমপি গোপালগঞ্জ-১, সাবেক ফুটবলার একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ এবং মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য অধ্যাপিকা রোমানা আলী টুসি গাজীপুর-৩ আসনে জয় পেয়েছেন।
অতীত বলছে এসব খেলার উন্নতির জন্য বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতির চেয়ারে তাদের বসালেও অনেকের অভিযোগ, খেলাটার জন্য এতটুকু সময় দেননি তারা। এই কর্মকর্তারা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রাজনীতিসহ অন্য বিষয় নিয়ে। তাহলে কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় তাদের?
এই ব্যক্তিত্বরা যখন সংসদে বসবেন, স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে যাবে ক্রীড়াঙ্গনের সবার। কিন্তু আদৌ কি সবাই সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন?
ফুটবল সংগঠক পরিচয়ে সাংসদ হওয়া কাজী নাবিলের কথায় ধরা যাক। আবাহনী লিমিটেডের ডিরেক্টর ইনচার্জ একজন হয়েও আকাশি নীলদের দুর্দশা যেন কাটাতে পারছেন না তিনি। ফুটবলে আবাহনী প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতেনি গত চার মৌসুমে।
সালাম মুর্শেদীর নিজের এলাকাতেও নিয়মিত ফুটবল লিগের আয়োজন হয় না। দীর্ঘ ৮ বছর পর ২০২২ সালে খুলনায় হয়েছে সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লিগ।
নৌকায় চড়ে এই ব্যক্তিত্বরা যেন ভুলে যান মাঠকে। মাঠের খেলাকে। এমনটাই মনে হয়েছে ব্যাডমিন্টনের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এলিনা সুলতানার, “একজন খেলোয়াড় হিসেবে বলতে চাই তাদের কাছে আমাদের মূল্যায়ন কতটুকু? খেলোয়াড়দের কারণেই ওই পজিশনে তারা। কিন্তু তাদের কাছে খেলোয়াড়দের সেই মূল্যায়ন নেই। এবং শুধু মূল্যায়ন না, যদি তারা নিজেদের দায়িত্বগুলো পালন করতো তাহলে আজ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এই অবস্থা হতো না।”
অথচ এই সাংসদদের ক্রীড়াঙ্গনে আরও বেশি অবদান রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করেন সাবেক শাটলার, “এখন যারা যেখানে আছেন তারা চাইলেই কিন্তু দেশের খেলাধুলার উন্নতিতে অনেক কিছু করতে পারেন। আমি আশা করবো সালাম মুর্শেদী ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করবেন। নিজের এলাকায় ফুটবল লিগ নিয়মিত আয়োজন করবেন।”
ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতাও যেন এই সাংসদেরা দেখভাল করেন সেটাও চাওয়া এলিনার, “আমি চাই তারা নিজেদের ফেডারেশনের বাইরে অন্য সব ফেডারেশনেও যেন সম্পৃক্ত হন। মাশরাফি ভাই ক্রিকেট নিয়ে যে পরিকল্পনা করবেন, ব্যাডমিন্টনেও যেন সেই অনুসারে এগিয়ে নিতে চাইবেন। শুধু বাজেট আনা নয়। বাজেটের আগে যে সব ব্যক্তি ফেডারেশনের চেয়ারে বসে আছে তাদেরও ঠিক করতে হবে।”
এসএ গেমসে সোনাজয়ী মাহফুজা খাতুন অবশ্য এই সাংসদদের নিয়ে একটু বেশি আশাবাদী, “ আশা করি এদের কাছে এবার আমাদের প্রত্যাশা বাড়বে। সাকিবের সঙ্গে যেহেতু বিকেএসপিতে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি যেহেতু ও আমার ব্যাচমেট তাই স্বাভাবিকভাবেই ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব। ও হয়তো আমাদের জন্য বেশিই কাজ করবে। তাছাড়া মাশরাফি ভাই আমাদের প্রজন্মের। উনার সঙ্গে আমাদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে কথা বলাটা সহজ হবে।”
মাহফুজা, এলিনাদের চাওয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই সাংসদদের। অতীতে কি হয়েছে সেটা ভুলে গিয়ে আবদুস সালাম মুর্শেদী এখন সামনের দিকে তাকাতে চাইলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার, “সম্মানের যে চূড়ান্ত শিখরে আজ আমি উঠেছি সেটা কিন্তু ফুটবল দিয়েই। তাই একজন সংসদ সদস্য হিসেবে ফুটবলের উন্নয়নে আমার যতটুকু ভূমিকা রাখা যায় সেটা রাখব। এমনকি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে এবং ফেডারেশনের সম্পৃক্ত অবস্থায় থেকে মনে করি এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।”
গতবার সালাম মুর্শেদী ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। এবার তিনি এই কমিটিতে না থাকলেও ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে আলাদা নজর থাকবে তার। এমনটাই জানালেন তিনি।
“ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যে স্থায়ী কমিটি আছে সেই কমিটি সব সংগঠকদের ডেকে তাদের নির্বাচন, কাঠামো, অবস্থান এগুলো ঠিক করে দেয়। কোভিডের কারণে যদিও গতবার অনেক কিছু নিয়ে কাজ করতে পারিনি। জানি না এবার এই কমিটিতে থাকব কিনা। তবে কমিটিতে থাকি আর না থাকি খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য ভালো কিছু করারই চেষ্টা করবো।”