পুলিশের চাকরির কারণে ঘুম উঠছিলো মাথায়। ১৫ বছর সেই অত্যাচার সহ্য করে ২০২১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন রাজবাড়ির সুনীল কুমার। গত বছর এ ঘটনাটি ফেইসবুকে ভাইরাল হলে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়।
ঘুমের কারণে কাজে বিরতি বা কাজের মধ্যে ঘুম আমাদের মধ্যে কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে আমাদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। আমাদের ছড়ায় রয়েছে,’আলসে নয় সে, ওঠে রোজ সকালে’। অর্থাৎ আমরা মনেই করি, রোজ সকালে উঠলেই, না ঘুমানোর চেয়ে পরিশ্রম বেশি করলেই সফলতা আসবে।
অথচ আইনস্টাইন ঘুমাতে বা আলসেমি করতে দারুণ ভালোবাসতেন। উইনস্টন চার্চিলের রকিং চেয়ারে বসে আধোঘুমে ঢুলতে থাকার অভ্যাস ছিল। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে এ দুইজনের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান কি আলসেমির ফল?
ইনভেনশনের জন্য প্রয়োজন হয় চিন্তার আর চিন্তার জন্য প্রয়োজন হয় ‘একঘেয়ে’ অলস সময় অথবা কাজ থেকে ছুটি।
আমেরিকান প্রফেসর আরনল্ড লুডভিগ এরকম ১ হাজার গুণীজনের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছেন- এইসব ব্যক্তিদের আলস্যই হয়তো তাদেরকে প্রভাববিস্তারকারী চিন্তা ও উদ্ভাবন করতে সহায়তা করেছে।
গবেষকরা বলছেন, টানা কাজের মাঝে ২০-৩০ মিনিটের ন্যাপ অথবা সংক্ষিপ্ত ঘুম কর্মীদের করে তুলতে পারে আরও সৃষ্টিশীল। তাদের দাবি, এমন ঘুম কাজে বাড়তি মনোযোগের জন্য ভালো।
অনেক দেশেই কর্মক্ষেত্রে ঘুমানোকে ফাঁকিবাজির লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করলেও জাপানে তা নয়। কিন্তু আপনি একবার ভাবুন তো, অফিসের বস আপনাকে যদি ঘুমাতে দেখেন তাহলে এইদেশে কী হবে! অথচ জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজের ফাঁকে কর্মীদের ঘুমিয়ে নিতে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া হয়। কাজের মাঝে এই ঝটিকা ঘুমকে সেদেশে ‘ইনিউমুরি’ বলা হয়। এমনকি মিটিংয়ের সময়ও জাপানে দেওয়া হয় ঘুমানোর অনুমতি। শুধু কি তাই? ইনিউমুরিকে দেখা হয় কঠোর পরিশ্রমের চিহ্ন হিসেবেও।
জীবজগতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন- আমরা প্রায়ই পরিশ্রমের উপকারিতার কথা বলতে গিয়ে পিঁপড়ার প্রসঙ্গ টানি। যদিও এ বিষয়ে পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ এবং অ্যারিজনা ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড্যান শারবনোর অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। বিশেষ প্রজাতির লাল পিঁপড়ার বাসা নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখতে পান, একটি পিঁপড়ার কলোনিতে থাকা অর্ধেকই সংখ্যকই দিনের বেশিরভাগ সময় অলস বসে থাকে। হতে পারে ভবিষ্যত দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কলোনির অর্ধেক পিপড়াদের রিজার্ভ রাখা হয়। আবার এমনও হতে পারে ওইসব পিঁপড়ার আসলেই কোনও ব্যস্ততা নেই। তাই শুয়ে-বসেই চলে যায় অর্ধেক দিন।
‘পরিশ্রমী’ পিঁপড়া সমাজ থেকে আমরাও কিন্তু শিক্ষা নিতে পারি- ‘কাজ না থাকলে অহেতুক খই না ভাজার’। পাল্টে দিন ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ প্রবাদটিকেও। সমস্বরে বলুন ‘নেই কাজ তো শুয়ে বসে থাক’।
যদিও দিনের অর্ধেক সময় এ কাজটি করলে ‘অলস’ তকমা জুটে যেতে পারে। সেন্ট্রাল ল্যাংকাশায়ার ইউনিভার্সিটির সাইকোলোজি এবং হিম্যানিটিস ডিপার্টমেন্টের লেকচারার ডক্টর স্যান্ডি মান অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন।
তার মতে, প্রোডাক্টিভ থাকতে গিয়ে যে পরিমাণ সময় ও শ্রম আমরা বিনিয়োগ করি, তা অপ্রয়োজনীয়। ইনভেনশনের উৎপত্তি শুয়ে বসে থাকার একঘেয়েমি থেকেই। কারণ যখনই কোন কাজ করতে করতে আমাদের একঘেয়েমি চলে আসে, তখনই আমাদের দরকার ছুটি। আর ছুটি মানেই নতুন কোন আইডিয়া। এই ‘ছুটি’ হতে পারে কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণ ঘুম অথবা নেহায়েত পায়চারি।
তাহলে জেনে নেওয়া যাক অলস সময় কাটানোর উপকারিতাগুলো-
চিন্তার জট থেকে মুক্তি
কোন কিছু নিয়ে মহা মুশকিলে আছেন? উপায় বের করতে পারছেন না? চিন্তা ভাবনা সব জট পাকিয়ে আছে? তাহলে আপনার ব্রেক দরকার। দরকার অলস সময়ে পড়ে পড়ে দিন কাটানোর। এতে আপনার মস্তিষ্ক পাবে বিশ্রাম এবং বৃদ্ধি পাবে যথাযথ যুক্তি সহকারে চিন্তার সক্ষমতা।
সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি করে
অলস সময় চিন্তা করে কাটিয়ে দেওয়া আপনার সৃষ্টিশীলতার নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে। এ সময় আপনি অনেক বেশি সৃষ্টিশীল চিন্তার সুযোগ পাবেন। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, আইজাক নিউটন আপেল বাগানে অলস সময় কাটানোর সময় মহাকর্ষের সূত্র আবিষ্কারের খোরাক পান।
শেখার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে
দীর্ঘ ক্লাস লেকচারে মনোযোগ ধরে রাখা যেমন কঠিন তেমনি তা আনন্দদায়কও নয়। আর যা আনন্দ দেয়না তা থেকে শেখাও যায়না। এমন পরিস্থিতিতে বিরতি নিন। ক্লাসের বাইরে কিছুটা সময় পায়চারি করে আসুন। অথবা চুপচাপ বসে থাকুন। সাময়িক বিরতি আপনার মস্তিষ্কে তথ্য প্রসেস করে সংরক্ষণ করতে সহায়তা করবে।
দক্ষতা বাড়ায়
গবেষণায় দেখা গেছে কাজ থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার ফলে মনো্যোগের উন্নতি ঘটে। বিরতির পর আবার কাজে ফেরত এলে তা প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে দেয়। তাই বিরতি নিন, আলস্যকে আলিঙ্গণ করুন এবং প্রোডাক্টিভিটি বাড়ান।
সহানুভূতিশীলতা
ব্যস্ততা আমাদের চিন্তা ও উপলোব্ধির দুয়ারকে কখনো কখনো রুদ্ধ করে রাখে। ফলে কাজ থেকে বিরতি এবং বিশ্রাম আমাদের স্বীয় গন্ডির বাইরে চিন্তা করতে এবং অন্যের প্রয়োজনে গুরুত্ব দিতে সহায়তা করে। তাই সাময়িক বিরতি কিংবা অলসতা আপনাকে আরও অর্থবহ কাজে নিয়োজিত হতে প্রলুব্ধ করে।
মেজাজ নিয়ন্ত্রণ
পেশাগত এবং পারিবারিক দায়িত্ব আপনার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ছুটি নিন, কোন কোন দিন গা এলিয়ে দিন বিছানায়। সাময়িক এই আলস্য আপনার মেজাজ মর্জি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সহায়তা করবে।