লায়ান জোহারির পৃথিবীটাই বদলে গেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না জোহারিসহ সৌদি আরবের সব নারীর। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই জোহারি এখন সৌদি নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। তাঁর মত হাজারো সৌদি নারী স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার।
সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’-এর অংশ হিসেবেই বদলে গেছে রক্ষণশীল দেশটি। সৌদি মেয়েরা এখন পরিবারের পুরুষ সদস্য ছাড়া যেতে পারছেন বিদেশে। অংশ নিতে পারছেন সেনাবাহিনীতে। খেলছেন ফুটবলও। তাই জাতীয় দলের খেলোয়াড় লায়ান জোহারির সন্তুষ্টি,‘‘গত বিশ্বকাপটা দেখেছি আগ্রহ নিয়ে। তবে এবারের বিশ্বকাপটা অন্যরকম ছিল। দেখেছি অন্য একটা দৃষ্টিভঙি নিয়ে, যেন ওরা আমাদের প্রতিপক্ষ। মনে হচ্ছিল আমরাও বিশ্বকাপ খেলতে পারি।’’
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, করিম বেনজিমা, নেইমাররা এখন খেলেন সৌদি আরবের ক্লাব ফুটবলে। বছর তিনেক আগেও অকল্পনীয় ছিল এটা। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকায় সময়ের সেরাদের এনে চমকে দিয়েছে সৌদি আরব। কাতারের মত তাদেরও চাওয়া বিশ্বকাপ আয়োজন। এজন্য বিশ্বসেরা তারকাদের এনে নিজেদের ভাবমূর্তি বদলাতে চাইছে সৌদি আরব। এরই অংশ হিসাবে জাগরণ হয়েছে নারী ফুটবলেরও।
প্রথম ম্যাচ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে
সৌদি আরবে নিষিদ্ধ ছিল জনসম্মুখে নারীদের খেলা। ২০০৭ সালে ফিফার এক আইনের কারণে ফুটবলে আরও অনাগ্রহী হয়ে উঠে তারা। সে বছর নারী ফুটবলারদের হিজাব পড়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয় ফিফা। ২০১২ সালে অবশ্য ফিফা আইনটি বাতিল করে।
২০১৮ সালে মেয়েদের স্টেডিয়ামে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার পরপরই সৌদি আরব ফুটবল ফেডারেশনে যোগ হয় নারীদের বিভাগ। ধীরে ধীরে গড়া হয় জাতীয় দল। সেখানে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড় আর অপেশাদার ফুটবলারই ছিল বেশি।
মনিকা স্টাবের কোচিংয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেইশেলসের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন সৌদি নারীরা। ঐতিহাসিক প্রীতি ম্যাচটা তারা স্মরণীয় করেন ২-০ গোলের জয়ে। ১৪ মিনিটে প্রথম গোল আল বানদারি মুবারাকের। পেনাল্টি থেকে দলের দ্বিতীয় গোল মরিয়ম আল তামিমির।
গত বছর জানুয়ারিতে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরেপাও জিতেছে সৌদি মেয়েরা। পাকিস্তান, মরিশাস ও কমোরোসকে নিয়ে আয়োজিত চার জাতি প্রীতি টুনামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা।
চালু হয়েছে পেশাদার লিগ
শক্তিশালী জাতীয় দল গড়তে দরকার উন্নত ঘরোয়া লিগের। এজন্যই সৌদি আরবে নারীদের ফুটবলে চালু হয়েছে পেশাদার লিগ। আল হিলাল, আল নাসর, আল ইত্তিহাদসহ আট দল নিয়ে ২০২০ সালে শুরু এই লিগের। তারকা অনেক খেলোয়াড়ও যোগ দিয়েছেন ক্লাবগুলোতে। আল ইত্তিহাদ যেমন দলে ভিড়িয়েছে সুইডেনের নুর মোস্তফা আর নাইজেরিয়ার অ্যাশলি প্লামপটেরেকে। তেমনি আল শাবাবা এনেছে ভেনিজুয়েলার তারকা অরিয়ানা আলতুভাকে। এই তারকাদের সুবাদে সৌদিতে নতুন দিগন্ত খুলবে মেয়েদের ফুটবলে।
আয়োজন করতে চায় ২০২৬ এশিয়ান কাপ
সৌদি নারীদের লক্ষ্য ২০২৭ সালের বিশ্বকাপ খেলা। গত বছরই প্রথমবার ফিফা র্যাংকিংয়ে জায়গা পাওয়া দলটির জন্য পথটা বেশ কঠিন। তবে ২০২৬ নারী এশিয়ান কাপ আয়োজন করা এতটা কঠিন নয়। এজন্য প্রাথমিক বিড করেছে সৌদি আরব। শেষ পর্যন্ত আয়োজক হলে সৌদিতে যে নারী ফুটবলের নতুন জোয়ার আসবে সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সৌদি জাতীয় দলের অধিনায়ক বায়ান সাদাগাহ,‘‘বড়দের দেখে আমি ফুটবল খেলতে শুরু করলাম, এরপর খেলাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। এশিয়ান কাপ সৌদিতে হলে আমার মত আরও হাজারো নারী প্রেমে পড়বে ফুটবলের।’’
০ থেকে ৫০,০০০ খেলোয়াড়
মেয়েদের খেলা অনুমোদনের পর সৌদি আরবে ফুটবলার ছিলেন না একজনও। সেখান থেকে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজার। ২০২১ সালের আগস্টে কোচ হিসাবে যোগ দেওয়া মনিকা স্টাব এখন নারী জাতীয় দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। সৌদিতে ফুটবলের প্রসারটা তিনি তুলে ধরলেন এভাবে,“আমি ৫০ বছর প্রায় ৯০টা দেশে নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করেছি। তবে সৌদি আরব ফুটবল ফেডারেশনের মত এত আন্তরিক সাহায্য পাইনি কোথাও। আমাদের অনুর্ধ্ব-১৭ দল আছে। এখন অনুর্ধ্ব-১৫ ও অনুর্ধ্ব-২০ দল গড়ব। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন শুরু করি তখন একজন খেলোয়াড়ও তৈরি ছিল না। এরপর প্রথম জাতীয় দলে অংশ নিতে আগ্রহ দেখায় ৪০০ জন। “
জাতীয় দল গঠনের আসল প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে একদম তৃণমূল থেকে। সেটা বুঝেই সৌদি ফুটবল স্কুলের মেয়েদের কাজ শুরু করেছে। গত দেড় বছরে নারী ফুটবলার ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানালেন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর মনিকা স্টাব, “এখন যা হচ্ছে সেটা অবিশ্বাস্য। প্রথমবার নারীদের স্কুল প্রতিযোগিতা শুরু করতে যাচ্ছি সৌদিতে। সেখানে অংশ নিতে নাম নিবন্ধন করেছে ৫০ হাজার জনের বেশি! এই খেলোয়াড়দের গড়ে তুলতে পারলে মেয়েদের ফুটবলে পরাশক্তি হয়ে উঠবে সৌদি আরব।”
প্রিন্স সালমানের বদলে যাওয়ার ডাকে মেয়েদের ফুটবলের স্বপ্নের ঘুড়ি ক্রমেই উপরে উঠছে।