Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

গরিব দেশগুলোয় তেল বাণিজ্যে মহাফন্দি সৌদি আরবের

Saudi_Oil
[publishpress_authors_box]

গরিব দেশগুলোতে তেল ও গ্যাসের বাণিজ্য বাড়াতে মহাপরিকল্পনা করেছে সৌদি আরব। সেন্টার ফর ক্লাইমেট রিপোর্টিং ও চ্যানেল ফোর নিউজের এক গোপন অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সমালোচকরা বলছেন, গরিব দেশগুলোকে ‘সৌদি আরবের ক্ষতিকর পণ্যের জালে আটকে’ ফেলার জন্যই পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে। পরিকল্পনাটির নাম অয়েল ডিমান্ড সাসটেইন্যাবিলিটি প্রোগ্রাম (ওডিএসপি)।

অনুসন্ধানে পরিকল্পনাটির সার্বিক বিষয়ে জানা যায়নি। তবে আফ্রিকা মহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত গাড়ি, বাস ও বিমানের ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে।

তেলের গ্রাহক চাহিদা সৃষ্টিতে টেকসই কর্মসূচি বা ওডিএসপির মাধ্যমে সুপারসনিক বিমান ভ্রমণ বাড়ানোর পরিকল্পনাও করছে সৌদি আরব। সুপারসনিক বিমানে প্রচলিত বিমানের চেয়ে তিনগুণ বেশি জেট জ্বালানি লাগে। গ্যাস ও ডিজেল চালিত সস্তা ইঞ্জিনের গাড়ি তৈরি করতে একটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি করছে দেশটি।

পরিকল্পনায় আরও রয়েছে, পাওয়ার শিপ বা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জাহাজের ব্যবহার বাড়ানো। পাওয়ার শিপের মাধ্যমে সমুদ্র উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এর জন্য প্রচুর পরিমাণ পরিবেশ দূষণকারী ভারী জ্বালানি তেল বা গ্যাস ব্যবহার করতে হয়।

সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান এই ওডিএসপির তত্ত্বাবধান করছেন। দেশটির সবচেয়ে বড় সংস্থাগুলোকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। দেশটির ৭০০ বিলিয়ন ডলারের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ), বিশ্বের বৃহত্তম তেল কোম্পানি আরামকো, পেট্রোকেমিক্যাল ফার্ম সাবিক ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোও এই কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে।

ওডিএসপিকে প্রকাশ্যে গরিব দেশগুলোতে জ্বালানি ও পরিবহন খাতের ‘বাধা দূর করা’ এবং ‘টেকসই’ কর্মসূচি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন- রান্নার জন্য লাকড়ির চুলার বদলে গ্যাসের চুলা সরবরাহ করা— এই পরিকল্পনার অংশ।

তবে সেন্টার ফর ক্লাইমেট রিপোর্টিং ও চ্যানেল ফোর নিউজের গোপন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ওডিএসপির উদ্দেশ্য মূলত তেল ও গ্যাসের বাণিজ্য বাড়ানো।

এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা সম্প্রতি বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অতীতের জীবাশ্মজ্বালানি ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের করে আনতে ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে ধনী দেশ ও কোম্পানিগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর নয়তো, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীরা বারবার স্পষ্ট করে বলছেন, জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে এর কোনও বিকল্প নেই।

সৌদি আরবও প্রকাশ্যে বলছে, তারা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়। আর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখলে ভালো হয়।

এই লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্মজ্বলানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তার মানে বেশিরভাগ তেল ও গ্যাসের মজুত মাটির নিচেই রাখতে হবে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবে এটি সৌদি আরবের মতো তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর আয়ের জন্য হুমকিস্বরূপ।

৩০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলো জীবাশ্মজ্বালানি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এনে পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি আদায়। তবে এবছর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সব রেকর্ড ভেঙেছে, চরম বিরূপ আবহাওয়ায় প্রাণ ও জীবিকা হারিয়েছেন বহু মানুষ।

থিঙ্কট্যাঙ্ক পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহাম্মদ আদো বলেছেন, “আফ্রিকাকে সৌদি সরকার মাদককারবারীদের মতো তাদের ক্ষতিকর পণ্যের জালে আটকানোর চেষ্টা করছে।

“সচেতন দেশগুলো যখন জীবাশ্মজ্বালানি থেকে মুক্ত হচ্ছে, তখন সৌদি আরব আরও বেশি তেলের গ্রাহকের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য তারা আফ্রিকায় নজর দিয়েছে। এটা ঘৃণ্য একটি কাজ।”

মোহাম্মদ আদো বলেন, “পরিবেশ দূষণে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর পথ ধরে আফ্রিকা সচেতন দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না। এর মানে, আমরা বিকল্প জ্বালানির পথে এগোতে পারব না। অথচ নবায়ণযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে আফ্রিকার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেরিতে উন্নয়নের একটা সুবিধাও আছে। এক লাফেই আমরা জ্বালানি ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে পারব।”

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ২০২১ সালে বলেছিলেন, “আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে একবারে বের করে পরিচ্ছন্ন, টেকসই জ্বালানিভিত্তিক অর্থনীতির পথে আনতে আমাদের পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সমর্থন লাগবে।”

ওডিএসপির ব্যপারে জানতে দ্য গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য চাওয়া হয়েছিল, তবে সাড়া মেলেনি।

ওডিএসপির ওয়েবসাইটের ইংরেজি ভার্সনে এই কর্মসূচিকে ‘অয়েল সাসটেইন্যাবিলিটি প্রোগ্রাম’ বলা হলেও আরবি ভার্সনে একে ঠিকই ‘অয়েল ডিমান্ড সাসটেইন্যাবিলিটি প্রোগ্রাম’ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।

আরবি সাইটে এই কর্মসূচির লক্ষ্য হিসেবে জ্বালানির প্রতিযোগিতামূলক উৎস হিসেবে হাইড্রোকার্বনের চাহিদা বজায় রাখা এবং বাড়ানোর কথাই বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, এজন্য হাইড্রোকার্বনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দক্ষতাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সৌদি আরবের জ্বালানি রূপান্তরও টেকসইভাবে করতে হবে।

গত জুন মাসে সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে ওডিএসপি ও সৌদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপোর্ট কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, এটি তেলের গ্রাহকচাহিদা বজায় রাখার কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করবে। পরের দিন অবশ্য বিবৃতিটি সংশোধন করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি সহজপ্রাপ্য করার কার্যক্রমের কথা বলা হয়।

সেন্টার ফর ক্লাইমেট রিপোর্টিং ও চ্যানেল ফোর নিউজের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী সেজে সৌদি সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। তখন তাদের কাছে ওডিএসপির প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ফাঁস হয় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তেল ও গ্যাসের চাহিদা বাড়ানোই এ কর্মসূচির লক্ষ্য।

সৌদি কর্মকর্তারা এক উপস্থাপনায় দেখান, ওডিএসপির কৌশলটি হলো অবকাঠামোয় বিনিয়োগের মাধ্যমে জ্বালানি সহজপ্রাপ্য করার পথের বাধাগুলো দূর করা এবং উদীয়মান বাজারগুলোতে তেলের চাহিদা বাড়ানো।

কোনও বাজারে কৃত্রিমভাবে তেলের চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্য আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে এক কর্মকর্তা বলেন, “হ্যাঁ, সেটিও আমাদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি না যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে এখনই সরতে পারবে। কারণ, পুরোপুরি বৈদ্যুতিক যানের ব্যবহারে যেতে তাদের তেমন অবকাঠামো লাগবে।”

তার ভাষ্য, আফ্রিকার অনেক দেশে এখনও দৈনিক চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নেই। তাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সহায়তা পাওয়া দরকার। ভবিষ্যতে তারা আরও টেকসই জ্বালানির দিকে যেত পারবে।

সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার সম্ভাবনা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ওডিএসপির ৪৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পগুলোকে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয়টি যথাক্রমে- পরিবহন এবং উপযোগিতা ও উপকরণ; তৃতীয়টি হলো- নির্মাণকাজে সিমেন্ট, ইস্পাত ও কাঠের বদলে তেল থেকে প্রাপ্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ানো।

ওডিএসপির এক কর্মকর্তা বলেন, “পরিবহন খাতে আমাদের উদ্দেশ্য হলো পরিবহন জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদী চাহিদা বাড়ানো। আমরা ডিজেল, পেট্রল ও জেট ফুয়েল নিয়ে কথা বলছি।” সড়ক নির্মাণে অর্থায়ন করাও এই পরিকল্পনার একটি অংশ বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “আমরা গ্যাস ও ডিজেল চালিত সস্তা ইঞ্জিনের (ইন্টারনাল কমবাসশন ইঞ্জিন- আইসিই) ব্যবহার বাড়াতে চাই। উদীয়মান বাজারগুলোতে স্বল্পমূল্যের গাড়ির সরবরাহ বাড়ানোও আমাদের লক্ষ্য। আফ্রিকায় মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ গাড়ির মালিক।”

তাদের তথ্যমতে, সৌদি আরব উৎপাদক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে স্বল্প মূল্যের গাড়ি তৈরি করবে, যাতে তা গরিব দেশগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। এতে সৌদি আরবের তেলের চাহিদাও বাড়বে।

সৌদি কর্মকর্তারা আরও বলেন, বাস, রাইড-শেয়ারিং ও ডেলিভারি পরিষেবাগুলোও ওডিএসপির পরিকল্পনায় রয়েছে। পেট্রোল ও ডিজেলের চাহিদা বাড়াতে গরিব দেশগুলোতে সস্তা ইঞ্জিনের গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে সৌদির।

বিমান পরিবহন খাত নিয়ে ওডিএসপির লক্ষ্য হলো, কম খরচের এয়ারলাইন অধিগ্রহণ বা চালুর জন্য বিনিয়োগ করা এবং ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো। সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, বাণিজ্যিক সুপারসনিক বিমান পরিবহনের দ্রুত উন্নয়নে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেছে। সুপারসনিক বিমানে সাবসনিক বাণিজ্যিক বিমানের তুলনায় কিলোমিটারপ্রতি আসনে তিনগুণ বেশি জ্বালানি খরচ হয়।

এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে তেলচালিত মিনি গ্রিড তৈরি করা। এর জন্য ডিজেল বা ভারি জ্বালানি লাগবে। ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র বহনকারী জাহাজ নির্মাণেও বিনিয়োগ করা হবে। এসব জাহাজেও ভারি জ্বালানি তেল বা গ্যাস লাগবে।

চলতি মাস নভেম্বরে সৌদি আরব রুয়ান্ডার সঙ্গে হাইড্রোকার্বন সম্পদের চাহিদা বাড়ানো, নাইজেরিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব জোরদার করা এবং ইথিওপিয়ার সঙ্গে তেল সরবরাহে সহযোগিতার জন্য চুক্তি করেছে।

পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহাম্মদ আদো বলেন, “আফ্রিকার দেশগুলো যে জ্বালানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং এই ফাঁদে পা দিচ্ছে তার জন্য মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোই দায়ী। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে বায়ুদূষণকারী দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলায় অর্থায়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।”

আদো আরও বলেন, “নিজেদের জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলার নেতা বলে দাবি করা ধনী দেশগুলো থেকে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। আর নয়তো আমরা এই ধরনের আরও অনেক অসাধুর ফাঁদে পড়ব। এতে শুধু আফ্রিকানরাই বিপদে পড়বে না, বরং সবার জন্য একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জলবায়ু নিশ্চিতে বিশ্বে যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে বাধা পড়বে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত