একজন ভালো রাজনীতিবিদ কোথায় পাওয়া যায়? এটি সর্বদেশীয় একটি প্রশ্ন। অধিকাংশ দেশেরই একটি জবাব : কবরস্থানে।
শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন :
‘‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাদের সমান।’’
পিনাকীশঙ্কর রায়চৌধুরীর হাতে শতবষের্র পুরোনো কবিতাটির ব্যঙ্গ-প্রকাশ ঘটেছে:
‘‘ হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ ভোটদান
জিতিলে সে নাহি রবে তোমাদের সবার সমান।
এমএলএ এমপি করে
তোমরা পাঠালে যারে
অ্যাসেমব্লিতে পার্লামেন্টে ভাগ্যগুণে পেয়ে গেলে স্থান
জিতে গেলে থাকে না সে তোমাদের সবার সমান।
ভোটেতে জিতিলে শেষে
বিগলিত হচ্ছে হেসে
প্লেনে চেপে চলে যাবে রাজধানী দিল্লীতে সটান
জিতে গেলে থাকে না সে তোমাদের সবার সমান।’’
বলা বাহুল্য এটি জনপ্রতিনিধি-বিরোধী কোনও নিবন্ধ নয়। ভোটের মওসুমে কতো কিছুই মনে আসে, ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই ঢাকা শহরেই লোটা মার্কা নিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা একজন প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার মিছিলে আমি যোগ দিয়েছিলাম। সে প্রার্থীর নামধাম কিছুই মনে নেই, যখন গিয়েছি তখন যে জানতাম এমনও নয়, আমি তাকে সমর্থন করি বা না করি তাতে তার কিছু আসে যায় না, কারণ ভোটার হতে আমাকে আরো বছর চৌদ্দ-পনের বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। মিছিল কোথায় যাচ্ছে আমার ধারণাও নেই। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, আমি ঢোলের বাড়ি শুনে মা’র দৃষ্টি এড়িয়ে মিছিলে মিশে যাই। আমিও মিছিলের গণসুরের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে থাকি: ‘‘সামনে আসছে শুভদিন লোটা মার্কায় ভোট দিন।’’
ভোট কি এবং কেমন করে দেবে আমার কোনো ধারণা নেই। তবুও বলছি: ‘‘সামনে আসছে শুভদিন লোটা মার্কায় ভোট দিন।’’
বহুক্ষণ পর ডান কানের লতিতে কঠিন টান পড়তেই সম্বিত ফেরে, চোখ তুলে দেখি এ হাত আমার বাবার। আমাকে যখন কান টেনে মিছিল থেকে বের করে এভাবেই টানতে টানতে বাসায় নিয়ে আসেন তখন গণতন্ত্রের প্রতি তার এই রূঢ় আচরণ আমাকে ব্যথিত করে। তখনও অপমানিত বোধ করিনি। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীর কন্যা শিশুটি যখন জানলা দিয়ে ঘাড় বের করে আমাকে দেখে, আমার চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে।
আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, লোটা মার্কার মিছিলে কেন গিয়েছিলি? আমি ভেবেছি অন্য কোনও মার্কা হলে হয়তো এই লাঞ্ছনা আমার হতো না। কিন্তু অন্য কি মার্কা হতে পারে? লোটার চেয়ে বদনা নিশ্চয়ই উন্নত মানের, কিন্তু বদনা মার্কা নিয়ে তো কেউ দাঁড়ায়নি। ষাটোত্তর জীবনে এখনও যখন নির্বাচনী প্রচার মিছিল দেখি আমি কানে বাবার কঠিন হাতের টান অনুভব করি। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সেই স্ট্যাটাস বহাল আছে, সম্ভবত সেটাই আমার জীবনের শেষ মিছিল।
আরও অনেক বছর পর পড়লাম, নির্বাচনের আগে যিনি তোমার করমর্দন করেন, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো ইলেকশনে পাশ করার পর তিনি তোমার স্বপ্নমর্দন করেই ছাড়বেন। স্বপ্নমর্দন মানে জীবনের স্বপ্ন দলিতমথিত করে বারোটা বাজিয়ে তবে ছাড়বেন। বেশ, তারপর থেকে স্বপ্ন অক্ষত রাখার তাগিদে নির্বাচনে দাঁড়ানো কোনো প্রার্থীর সাথে হ্যান্ডশেক করাও বন্ধ করে দিয়েছি। যদিবা কেউ কখনো হাত বাড়ান, বিদুৎগতিতে আমি হাতটা আমার পশ্চাদদেশে ঠেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু যে নির্বাচনের সময় বুঝতে পারলাম ভোট একটি পবিত্র আমানত, আমানতের সঠিক ব্যবহার না করা রীতিমতো কবিরাহ গোনাহ, এবং ভোট না দেওয়া কোনো কোনো দেশে দণ্ডনীয় অপরাধ, আমি দ্রুত ভোট দিতে চলে গেলাম। আমি গুরু বা লঘু কোনো মানের গোনাহগার হতে চাই না, ফৌজদারির দণ্ডও না। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আমার স্বজাতি সম্পর্কে আমার এতোদিনকার ধারণাই পাল্টে গেল। কে বলে বাঙ্গালি স্বার্থপর, অন্যের উপকার করে না! আমাকে গোনাহ থেকে মুক্ত রাখতে কেউ একজন আমার ভোটটা দিয়ে দিয়েছেন। গায়ে পড়ে এমন উপকার ইংরেজরা করে? ফরাসি বা জার্মানরা করে? রোমান কিংবা গ্রিকরা? এমন উপকারীর দেখা মিলে বাংলাদেশের ভোটকেন্দ্রে।
কিন্তু আমি কোন মার্কায় কাকে ভোট দিতাম সেটা তো তার জানার কথা নয়। আমি ব্যবস্থাপকদের একজনকে বলি। তিনিও বললেন, কথা ঠিক। কিন্তু মহামতি লেনিনের উত্তরসূরী স্ট্যালিন বলেছেন, কে ভোট দিচ্ছেন কাকে ভোট দিচ্ছেন, সেটা কোনো বিষয় নয়, কে ভোট গুনছেন তিনিই আসল, কাকে পাশ করাতে হবে তিনিই জানেন।
ভোটকেন্দ্রের এই কাহিনীটা না জানার কোনো কারণ নেই। বহু বছর আগে কলেরায় স্ত্রী হারানো এক বৃদ্ধ ভোট দিতে গিয়ে জানলেন তার স্ত্রী কিছুক্ষণ আগে ভোট দিয়ে চলে গেছেন। এর পর থেকে বুড়ো নির্বাচনের দিন সকালেই ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকেন, কতোদিন পর ভোট দিতে আসা তার প্রয়াত স্ত্রীর সাথে দেখা হবে।
গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বাধা দেওয়া নয়, নির্বাচনকে উপলক্ষ করে বহু বছর ধরে চালু বিভিন্ন ধরনের কিছু রাজনৈতিক তামাশা উপস্থাপনই এই সংকলনধর্মী রচনাটির উদ্দেশ্য।
তামাশা ১:
কোনও এক ইউরোপীয় দেশের অর্থমন্ত্রীর অতিরঞ্জিত বাজেটভাষণ শুনে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য বললেন, এই ভাষণের মরণোত্তর প্রকাশনা জরুরি হয়ে পড়েছে এবং আর তা যতো তাড়াতাড়ি হয় ততোই মঙ্গল। দেশ ও জাতির এই উপকারে অর্থমন্ত্রী এগিয়ে আসবেন কি?
তামাশা ২:
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরুজনরা মিথ্যা বলেননি— স্কুলে যাওয়ার জন্য এখন যতো কাঁদুক না কেন, স্কুলে না যাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে আরও বেশি কাঁদতে হবে। সুবিধা ছিল এই ঠাকুরের। স্কুলে বেশিদিন যাননি। স্কুলের কাজটা বাড়িতেই সেরেছেন।
সংসদ সদস্য হওয়ায় জন্য আমাদের সমাজসেবকরা যে কসরৎ করছেন সংসদ এড়ানোর জন্য সংসদ সদস্যদের তার চেয়ে বেশি কসরৎ করতে হয়। সংসদ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কিংবা তাড়িয়ে বেড়ানোর একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব এড়ানো খুব মুশকিল। আমাদের সংসদীয় সংস্কৃতি, অন্তত সংসদ ভবনের ভিতরে মোটামুটিভাবে একদলীয়। পশ্চিমের গণতন্ত্রমুগ্ধ একটি ডেলিগেশন সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্টকে গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করলো। বললো, অন্তত দুটো দল থাকুক। তাতে কেউ আপনাকে অগণতান্ত্রিক বলে গাল দিতে পারবে না। ভদকা আর এক ঢোক সেবন করে প্রেসিডেন্ট বললেন, আহা খুব চমৎকার আইডিয়া। দুটো দলই দরকার। একদল ক্ষমতায়, একদল জেলখানায়। আজই ফরমান জারি করে দেবো। এখন বুঝতে পারছি গণতন্ত্র ব্যাপারটা আসলে কেমন।
তামাশা ৩:
লুই আই কানের স্থাপত্যকীর্তির ভিতরে যারা গিয়েছেন তারা তো শুনেছেনই যারা বাইরের দেয়ালে কান লাগিয়েছেন তারাও শুনেছেন কখনো কখনো পাগলা ঘণ্টি বাজে। গল্পটা বাংলাদেশের হলেও ভালো মানাতো। তারপরও গল্পটা সংসদীয় গণতন্ত্রের পবিত্র ভূমি ব্রিটেনের।
বাবা-মা আর তাদের ছোট্ট ছেলে এই প্রথম এসেছে ওয়েস্টমিনস্টারে। তখন সেশন চালু আছে। ভিতরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো অবিরাম ঘণ্টাধ্বনি। মন্ত্রীরা প্রস্তুত। খাকি পোশাকের পুলিশ এদিক ওদিক ছুটছে। এদের একজন সার্জেন্ট-এট-আর্মস। সব দেখে ঘণ্টাধ্বনি শুনে দিশাহারা অবস্থা। বাবা মা’কে জিজ্ঞাসা করলো— কি ব্যাপার, ঘণ্টা বাজাচ্ছে কেন?
মা জবাব দেওয়ার আগেই ছেলে জবাব দিল, আমি জানি। ওদের একজন নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে।
আমাদের সংসদে বরাবরই ট্রেজারির দৌরাত্ম্যে অপজিশন পালিয়েই থাকে। পাগলা ঘণ্টি বাজতেই থাকে। অপজিশনের দৌরাত্ম্যও কম নয়। ঘণ্টিঅলাও জানে যতোদূর যেতে চায় যাক। হাজিরা ভাতা আর রাহা খরচ নিতে আর আইএসডি টেলিফোনে মুফতে বাতচিৎ করতে যার যার সময় মতো প্রত্যেকেই ফিরে আসবেন। ঋণখেলাপি, টেলিফোন বিলখেলাপি আর সংসদ লাইব্রেরির বই খেলাপিরা সহজে সংসদের মায়া কাটাতে পারবেন না।
তামাশা ৪:
একটার্ম সংসদের স্পিকার হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালনের পর অর্ডার অর্ডার বলে চেঁচাতে চেঁচাতে যখন স্পিকার মৃত্যুবরণ করলেন, পরলোকের দ্বারপাল এই মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করে বললেন, স্পিকার হিসেবে বেচারা নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। এতোদিনে তার পাপস্খলন হয়ে গেছে। এখন তাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। বলে স্পিকারকে স্বর্গে ঠেলে দিলেন।
আর একজন সাংসদ দুটার্মে ১০ বছর স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর সংসদ সদস্যদের অশ্লীল এবং অশ্রাব্য গালাগাল শুনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। তার তো স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত। কিন্তু পরকালের দ্বাররক্ষী বেঁকে বসলেন। বললেন, দ্বিতীয় টার্মে এসে তার নরকযন্ত্রণা সয়ে গেছে। সুতরাং নরকেই থাকুন মাননীয় স্পিকার।
তামাশা ৫:
জ্যাক ও জিল দু’জনই প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। গত চল্লিশ বছর ধরে পার্টনারশিপে দু’জন রাজনীতি ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। জমজমাট ব্যবসা।
এদের একজন জ্যাক তখন মৃত্যুশয্যায়। শিয়রের কাছে অবস্থান করা জিলকে বললেন, ‘‘দোস্ত, মৃত্যুর আগে আমার পাপের কথা তোমাকে জানাতে চাই। গত তিরিশ বছর ধরে সুযোগ পেলেই তোমার স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করার চেষ্টা করেছি। সফলও হয়েছি। তোমার দ্বিতীয় সন্তান এমিলি আসলে আমার মেয়ে। তার ওপর তোমার স্ত্রী ও দু’সন্তানকে মাঝেমধ্যে যে গিফট দিয়েছি, তাও আমার ব্যক্তিগত অর্থে নয়, আমাদের ব্যবসায়ের টাকা মেরেই কাজটা করেছি। তাছাড়া কিছু কিছু হিসাবে আমি গোঁজামিল দিয়েছি। আমি সব দোষ স্বীকার করেই মরতে চাই।
জিল বলল, দোস্ত যা হওয়ার হয়েছে। ওসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। অতীত রবাবরই অতীত। আমি গত সাড়ে উনত্রিশ বছর ধরে তোমার মাটির্নির গ্লাসে একটু একটু করে আর্সেনিক ঢেলে আসছি। এতদিনে তাহলে…।
তামাশা ৬:
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য আলেকজান্ডার স্মিথ টানা বক্তৃতা দিয়ে যেতেন। সহজে মাইক ছাড়তে চাইতেন না। স্পিকারও হাই তুলতেন। এমনি এক বক্তৃতার সময় সদস্যরা বেরিয়ে যেতে থাকে। একজন সদস্য হেনরি ক্লে জায়গায় বসেই খুব বিরক্ত প্রকাশ করেন। ব্যাপারটা আলেকজান্ডার স্মিথের চোখে পড়ে। স্মিথ বলেন, বিরক্ত হচ্ছেন কেন? আপনারা তো বলেন, কেবল বর্তমানের কথা। আমি বলি উত্তরকালের কথা। হেনরি ক্লে বললেন, স্মিথ তোমার বক্তব্যের ধরন দেখে মনে হচ্ছে তোমার টার্গেট উত্তর প্রজন্ম জন্মগ্রহণ করে বড় হয়ে সংসদে না আসা পর্যন্ত তুমি থামবে না।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি :
‘‘আমাকে যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
সাতখুন আমি মাফ করে দেব
তোমার হবে না সাজা।’’
খুন সাতটা হোক কি চোদ্দটা সমস্যা নেই, অন্নদাশঙ্কর রায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
ইমেইল: [email protected]