ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ১২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি অংশীদারত্ব আছে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে যাদের অন্য দেশে ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আবেদনকারীদের তালিকায় আছে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, মোবাইল অপারেটর রবি, বাংলালিংকের অংশীদারত্বে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানও।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। পরে সময়সীমা বাড়িয়ে ২ নভেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
রবিবার ছিল আবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন।
কারা আবেদন করল
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১২টি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য আবেদন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ব্রিটিশ বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, ডিজিটাল ব্যাংকিং অব ভুটান-ডিকে, আমার ডিজিটাল ব্যাংক-২২ এমএফআই, ৩৬ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, বুস্ট-রবি, আমার ব্যাংক, অ্যাপ ব্যাংক-ফার্মারস, নোভা ডিজিটাল ব্যাংক-বাংলালিংক অ্যান্ড স্কয়ার, মৈত্রী ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, উপকারী ডিজিটাল ব্যাংক, মুনাফা ইসলামী ডিজিটাল ব্যাংক-আকিজ এবং বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক।
ডিজিটাল ব্যাংক কী
ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। তবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি হবে স্থাপনাবিহীন। অর্থাৎ এই ব্যাংক কোনও ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেবে না। এর নিজস্ব কোনও শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না। সব সেবাই হবে অ্যাপনির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে।
একটি ডিজিটাল ব্যাংকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা মিলবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চ্যুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনও উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে। তবে লেনদেনের জন্য কোনও প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন।
ডিজিটাল ব্যাংক কোনও ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। বড় ও মাঝারি শিল্পেও কোনও ঋণ দিতে পারবে না। শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।
দেশে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০২৩ সালে। ওই বছরের ২০ জুন আগ্রহীদের থেকে আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আবদন চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৫২টি আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে তিন ধাপে আবেদন মূল্যায়ন করে ৯টি প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিচালনা পর্ষদের সভায়।
তবে নগদ ও কড়ি ছাড়া বাকি সাতটি আবেদনের মধ্যে স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক, নর্থ ইস্ট ডিজিটাল ব্যাংক এবং জাপান-বাংলা ডিজিটাল ব্যাংককে পরে এলওআই দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আর বিকাশ, ডিজি টেন এবং ডিজিটাল ব্যাংককে আলাদা লাইসেন্স না দিয়ে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং উইং’ খোলার অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আবেদন নাকচ করা হয়।
নীতিমালা
২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের লক্ষ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তা অনুমোদন করে। ওই নীতিমালার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করে।
নীতিমালায় বলা হয়েছিল, ডিজিটাল ব্যাংকের কোনও শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনও স্থাপনা থাকবে না। মুঠোফোন অথবা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেই গ্রাহকদের ব্যাংক সেবা দেওয়া হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী চলবে এই ডিজিটাল ব্যাংক।
মূলধন লাগবে ৩০০ কোটি টাকা
ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ৩০০ কোটি টাকা। এর আগে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন করা হয়েছিল ১২৫ কোটি টাকা। পরে তা ১৭৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২১ আগস্ট এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, “ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ১৩ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শাখাবিহীন ডিজিটাল ব্যাংক-কোম্পানি স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করিল।”
২০২৩ সালের ১৫ জুন ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা ঘোষণা করেছিল, তাতে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ১২৫ কোটি টাকার কথা বলা হয়েছিল।
নতুন প্রজ্ঞাপনে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ১২৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি করা ছাড়া আগে জারি করা নীতিমালার অন্য সব শর্ত অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক করতে প্রয়োজন হয় ৫০০ কোটি টাকার মূলধন। ২০২৩ সালের নীতিমালায় শর্ত ছিল একেকটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। এখন লাগবে ৩০০ কোটি টাকা
অন্যান্য শর্ত
নীতিমালায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বা শেয়ার ছাড়তে হবে। আইপিওর পরিমাণ হতে হবে স্পন্সরের প্রাথমিক অবদানের ন্যূনতম পরিমাণের সমান।
শর্তে আরও বলা হয়েছে, এই ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে।
কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনও সদস্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ কতজন পরিচালক হতে পারবেন, তা ঠিক হবে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী।
ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, রেগুলেশন, গাইডলাইন, সার্কুলার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।


