যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই ট্যারিফ বা আমদানি শুল্ক নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মিত্র ও শত্রু দেশের ওপর নির্বিচারে শুল্ক আরোপ করে এরইমধ্যে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।
তবে শুল্ক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি মামলার ফলাফল যাই হোক না কেন, ট্রাম্পের আরোপিত এই কর ব্যবস্থা সম্ভবত একভাবে বা অন্যভাবে টিকে থাকবেই। ট্রাম্পের প্রথম আমলের পর জো বাইডেনের আমলেও তা দেখা গিয়েছিল।
বুধবার বাণিজ্য আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তা তার ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়েছে। কিন্তু তার আগেই হোয়াইট হাউসে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছিল।
হোয়াইট হাউসের দুজন জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আদালত এই জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার খারিজ করে দিলে অন্যান্য আইনি পথ ব্যবহার করে একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রস্তুতি রয়েছে প্রশাসনের।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা মনে করি আমাদের মামলাটি শক্তিশালী এবং আমরা জিতব। তবে প্রয়োজনে আমাদের হাতে অন্যান্য উপায় রয়েছে, যা দিয়ে আমরা একই অবস্থানে পৌঁছাতে পারি।”
২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপিল আদালত স্থগিত করেছে বাণিজ্য আদালতের সেই রায়। তবে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে উভয় পক্ষের শুনানির পর।
আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি বিকল্প পথও খুঁজে দেখছে হোয়াইট হাউস। এই বিকল্প পথগুলো মূলত বিভিন্ন বাণিজ্য আইনের ধারা, যার মাধ্যমে আবারও শুল্ক আরোপ সম্ভব।
ট্রেড অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ধারা ১২২
আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যে বড় ঘাটতি দেখা দিলে এই আইনে প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ট্যারিফ ১৫০ দিনের জন্য আরোপ করতে পারেন। একে বলে ব্যালান্স অব পেমেন্টস ঘাটতি। অর্থাৎ যখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি, রপ্তানির তুলনায় অনেক বেশি হয়।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যে ৮৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়েছে। ট্রাম্প বারবার দাবি করেন, বড় বাণিজ্য ঘাটতি মানেই যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকানো হচ্ছে এবং অনুচিত আচরণ করা হচ্ছে। যদিও অনেক অর্থনীতিবিদ এতে একমত নন। বরং তারা বলেন, বড় বাণিজ্য ঘাটতি একটি শক্তিশালী অর্থনীতির পরিচায়কও হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন শুরুতে ধারা ১২২ ব্যবহার করে শুল্ক বাড়ানোর কথা ভাবলেও, ১৫০ দিনের সীমাবদ্ধতার কারণে সেই পথে যায়নি। তবে এখন এই পথ ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। এতে প্রাথমিকভাবে সব দেশের রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ হার ধার্য করা হতে পারে।
১৫০ দিন শেষে এই ট্যারিফ কেবলমাত্র কংগ্রেস অনুমোদন দিলে চালু রাখা যাবে।
ট্রেড এক্সপ্যানশন অ্যাক্ট ১৯৬২-এর ধারা ২৩২
এই ধারা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক ট্যারিফ আরোপ করতে পারেন। তবে এর আগে একটি তদন্ত চালাতে হয়।
সম্প্রতি একটি ২৩২ তদন্তে বলা হয়েছে, বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এই ধারায় এখনও বেশ কিছু খাতে তদন্ত চলছে। অতীতে ধারা ২৩২ ব্যবহার করেই ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়ি ও যন্ত্রাংশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। আদালতের জরুরি ক্ষমতা সংক্রান্ত রায় যাই হোক না কেন, এই শুল্ক বহাল থাকতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম্প এখন খাতভিত্তিক শুল্ক নিয়ে কম কথা বললেও, যদি দেশভিত্তিক শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আসলে খাতভিত্তিক শুল্ক আবার অগ্রাধিকার পেতে পারে।
ট্রেড অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ধারা ৩০১
এই ধারা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএরটিআর) অন্য দেশের বাণিজ্য আচরণ যদি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার ওপর অন্যায় ও বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে এই ধারা ব্যবহার করে চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়েছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উড়োজাহাজসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপরও এই ধারা প্রয়োগ হয়েছিল।
তবে এই প্রক্রিয়া তুলনামূলক দীর্ঘ। কারণ এতে জনমত গ্রহণসহ বেশ কয়েকটি ধাপ থাকে। ফলে শুল্ক কার্যকর হতে সপ্তাহ বা মাস লেগে যেতে পারে।
এই ধারার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, শুল্কের হার বা সময়কাল সীমাবদ্ধ নয়। ফলে একবার কার্যকর হলে প্রশাসন ইচ্ছামতো তা বজায় রাখতে পারে।
ট্যারিফ অ্যাক্ট ১৯৩০-এর ধারা ৩৩৮
এই পুরনো আইন এখন পর্যন্ত কোনও প্রেসিডেন্ট ব্যবহার করেননি। তবে প্রেসিডেন্ট চাইলে এই ধারা অনুযায়ী, যদি মনে করেন কোনও দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করেছে, তাহলে তাদের আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসাতে পারেন।
তবে এই আইন প্রয়োগ করলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘিত হতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো পাল্টা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।
সবশেষে কী
আদালতের রায় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় ধাক্কা হলেও, তারা বলছে এই রায় তাদের অবস্থান বদলাবে না। কারণ এই উচ্চ হারে ট্যারিফ আরোপের হুমকি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।
একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিষয়ে ১০০ শতাংশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন