Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

যে রাতে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ জুলাই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও ভাংচুর হয়। তার মধ্যেও কেউ এই ফুল রেখে গেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ জুলাই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও ভাংচুর হয়। তার মধ্যেও কেউ এই ফুল রেখে গেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

১৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে শোকের একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এই দিনটি ভিন্ন আবহে এবার পালিত হবে বাংলাদেশে। এবার রাষ্ট্রীয় শোক দিবসের কোনও কর্মসূচি নেই, নেই সাধারণ ছুটিও।

তবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় দেশবাসীকে শোক দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই বার্তায় বলা হয়, “আপনাদের কাছে আবেদন জানাই, যথাযথ মর্যাদার সাথে ভাব গম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ই আগস্ট পালন করুন। বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।”

দুদিন আগে জয় নিজেও এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “১৫ আগস্ট, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রতি শান্তিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। জাতির পিতার স্মৃতিকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার যে ষড়যন্ত্র চলছে, আপনার-আমার-সবার শ্রদ্ধা নিবেদনই হোক তার প্রতিবাদ।”

গত ১ আগস্ট ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশে কৃষক লীগ আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। তার চার দিন পরই তার সরকারের পতন ঘটে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারত যাওয়ার পর বিক্ষোভের আগুনে পোড়ে সারাদেশের আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও দলটির নেতাদের বাড়ি। ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনেও ভাংচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি এখন ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাদুঘরে যা যা ছিল, সবই লুট হয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউই প্রকাশ্যে নেই। তবে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে ধানমণ্ডিতে কর্মসূচি থাকছে।

গত ১২ আগস্ট বিবিসি বাংলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

অজ্ঞাত স্থানে থেকে হানিফ বলেন, “ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বলে আমি জেনেছি।”

এদিকে এর মধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বরগুনার নেতা জাহাঙ্গীর কবিরের একটি ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। যেখানে ১৫ আগস্ট সারাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে মৌনমিছিলের আয়োজনের আলোচনা করতে শোনা যায়। সেই জাহাঙ্গীর কবিরকে বুধবার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর এখন ধ্বংসের চিহ্ন বুকে দাঁড়িয়ে।

বুধবার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে বৃহস্পতিবার সকালে কর্মসূচির কথা জানা গেলেও তা কখন, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি।

সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় কেউ বলছিলেন সকাল ৭টায়, কেউবা বলছিলেন সকাল ৮টায়। তবে সেখানে কারা কারা যাবেন, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।

আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তার নাম গোপন রাখার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা সকাল ৮টায় হবে। এটা ফুল দেওয়ার প্রোগ্রাম। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি।

“আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী। এখানে সবাই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাবে। জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো নাগরিকের অধিকার।”

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেখেন কী হয়? প্রোগ্রাম তো একটা সকাল ৭টায় হওয়ার কথা আছে। সবাই তো যাবে না। কেউ কেউ যাবে।”

শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যা দিয়ে এই সরকারের সহযোগী সবাইকে ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।

শেখ হাসিনাকে হটিয়ে দিয়ে তারা যে ‘বিপ্লব’ করেছে, তা নস্যাৎ করতে ১৫ আগস্ট ঘিরে আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে বলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভিযোগ এসেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের চিন্তিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের ওই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, “প্রতিবিপ্লবের শিকার তো আমরা। আমরা কিসের প্রতিবিল্পব করব।”

গত দেড় দশক ধরে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছিল। এদিনে সবাই শ্রদ্ধা জানাত ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে। ফাইল ছবি

স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যা করে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল, এমন বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা কখনও হয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়।

‌আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর ২০০১ সালে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি।

‌তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ফেরার পর ১৫ আগস্ট নিয়ে সিদ্ধান্ত আবার বদলে যায়। জাতীয় শোক দিবসের মর্যাদা হারায় দিনটি, সাধারণ ছুটিও বাতিল হয়।

‌২০০৮ সালে হাই কোর্ট এক রায়ে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পুনর্বহালের আদেশ দেয়। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসাবেই পালিত হচ্ছিল। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে সংশোধন আনা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর দিনটি আবার দলীয় কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৫ খুনি এখনও অধরা

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের দায়মুক্তি দিতে আইনও করা হয়েছিল। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে সেই আইন বাতিল করলে বিচারের পথ খোলে।

ওই বছরের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন।

আপিল হলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়।

তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আবার ঝুলে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর তা নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেয়।

এরপর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

পলাতক খুনিদের মধ্যে আবদুল মাজেদ ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল ধরা পড়ার পর ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আরেক খুনি আজিজ পাশা ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বাকি পাঁচজনের মধ্যে এম বি এইচ নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। তাদের ফেরাতে আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সফল হয়নি।

বাকি তিন খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে খবর আসে, তারা তিনজন মূলত পাকিস্তানে থাকেন। সেখান েথকে বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করে থাকেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত