বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ বাবদ ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ (১.৩৪ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।
এই অঙ্ক ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার শোধ করা হয়েছিল।
টাকার অঙ্কে গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এর আগে কোনও অর্থবছরে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ শোধ করেনি বাংলাদেশ।
ডলারের দাম বাড়ায় টাকার অঙ্কে সুদ পরিশোধ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) রবিবার মোট ঋণ, প্রতিশ্রুতি ও সুদ-আসল পরিশোধসহ বিদেশি ঋণের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৯৮৯ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার (৯.৮৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১৫ কোটি ৪০ লাখ (২.২৫ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা মোট ঋণ-সহায়তার ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি।
১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা।
অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে রাশিয়া দিয়েছে ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। চীন দিয়েছে ৩৯ কোটি ৭ লাখ ডলার। ভারত দিয়েছে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৬৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার।
এছাড়া অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে ৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে, তার মধ্যে ৩৩৫ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার (৩.৩৫ বিলিয়ন) ডলার চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
হিসাব বলছে, মোট ঋণ-সহায়তার ৩৪ শতাংশ চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ২ বিলিয়ন ডলার। আর সুদ প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯২৬ কোটি ৬৮ লাখ (৯.২৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। আসল বাবদ শোধ করা হয়েছিল ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের শুরু থেকে সরকারের বিদেশি ঋণ গ্রহণ বাড়তে শুরু করেছিল। তবে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এসে তা কমে যায়; ঋণাত্মক (-) প্রবৃদ্ধিতে চলে আসে।
তবে ডিসেম্বরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ ছাড় করে দাতারা। পরের কয়েক মাসেও কম-বেশি ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ-সহায়তা পায় বাংলাদেশ। আর এতেই ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়েছে। আগের মে মাস পর্যন্ত অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল নামমাত্র, দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক হাজার ৭২ কোটি ৩৩ লাখ (১০.৭২ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের দাতাদের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ২২ শতাংশ।
গত অর্থবছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের যে বিদেশি ঋণ-সহায়তা এসেছে, তার মধ্যে ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ৬২ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার ডলার হচ্ছে অনুদান। অনুদানের মধ্যে ৫৯ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার ডলার প্রকল্প সহায়তা। আর ৩ কোটি ডলার খাদ্য সহায়তা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।
কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতি বছরই ঋণের অঙ্ক বাড়ছে। আর ঋণ বাড়লে তো সুদ বাড়বেই।”
তিনি বলেন, “গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে সুদ পরিশোধের পরিমাণ।”