Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে হাই কোর্টের রায়

সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট।
[publishpress_authors_box]

আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছিল আওয়ামী লীগ, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবার আদালতই নির্বাচনকালীন এই সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে রায় দিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষে মঙ্গলবার এই রায় দেয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ নাগরিকের করা রিট আবেদনে রুল জারির পর ১১ কার্যদিবস শুনানি নিয়ে উচ্চ আদালতের এই রায় হলো।

রায়ে সিদ্ধান্ত

পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫৪টি বিধানের মধ্যে ৪টি বিধান অবৈধ ঘোষণা করে সেগুলো বাতিল করেছে হাই কোর্ট।

একই সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদের হাতে এ সংশোধনীর বাকি ৫০টি বিধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ অনুচ্ছেদ (পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ‍ও ২১ ধারা) বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।

রায়ে গণভোট ফিরিয়ে এনে বলা হয়েছে, যেহেতু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে গণভোট বাধ্যতামূলক, সেহেতু সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরিবর্তন আনাও অসাংবিধানিক হয়েছে। ফলে ১৪২ অনুচ্ছেদ হুবহু পুনস্থাপন করা হলো।

অন্যদিকে, সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ সংক্রান্ত সংবিধানের ৭ (ক) এবং ৭ (খ) অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে আদালত।

অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করা হলে এবং এই সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা উদ্যোগ গ্রহণ ও ষড়যন্ত্র করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন বলে উল্লেখ করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ঠিক করা ছিল মৃত্যুদণ্ড।

রায়ে সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশে সংবিধানের ৪৪ (২) অনুচ্ছেদে নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণে উচ্চ আদালতের বাইরে অন্যান্য আদালতকে দেওয়া ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধান বাতিল করা হয়েছে।

আদালতের পর্যবেক্ষণ

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধান হচ্ছে একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইনই সংবিধানের নিরিখে বিচার্য হবে। আর সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। যে কোনও আইনেরই বৈধতা অবৈধতা নিরূপণ করবে সুপ্রিম কোর্ট।

সংবিধান কেবল অতীত এবং বর্তমানকে নিরূপণ করে না, এটা ভবিষ্যতে কোনও উদ্ভূত বিষয়ের জন্যও।

একইভাবে সংবিধান কেবল দালিলিক নথি নয়, এটি একটি জীবন্ত দলিল অভিহিত করা হয় রায়ের পর্যবেক্ষণে।

আদালত বলেছে, একটি সংবিধান একটি জাতির ভিত্তি এবং মৌলিক নির্দেশক, যা উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। সংবিধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশমান এবং পরিবর্তনশীল। সময় এবং সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী বিকাশমান এবং পরিবর্তনশীল।

সাংবিধানিক ও আইনগত পরিবর্তনগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অনুযায়ী করতে হবে উল্লেখ করে পর্যবেক্ষলে আরও বলা হয়, সেখানে সংবিধানের সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংসদকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বা সংসদের ক্ষমতাকে সীমিত করা হয়েছে মৌলিক কাঠামো দ্বারা। পঞ্চদশ সংশোধীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়; যদিও মৌলিক কাঠামো অসংশোধনযোগ্য।

সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে, তা আপিল বিভাগের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে হাই কোর্টের এই রায়ে দাবি করা হয়।

পর্যবেক্ষণে বিচারকরা বলেন, একমাত্র গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা যায় এবং গণতন্ত্র হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এটি কোনোভাবেই সংশোধন করা যাবে না। গণতন্ত্র বিকশিত হয় একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে।

“যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মূল সংবিধানে ছিল না। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের অভিপ্রায়ে ১৯৯৬ সালে তা সংবিধানে যুক্ত করা হয়। ফলে এই ব্যবস্থাটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশে পরিণত হয়েছে।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের আস্থার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি বলেও আদালতের পর্যবেক্ষলে বলা হয়েছে।

“এই তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।”

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে এর সর্বশেষ প্রতিফলন উল্লেখ করে আদালত বলেছে, “সরকারকে বিতাড়িত করতে গিয়ে হাজার হাজার হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি নতুন গণতন্ত্র, নতুন স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশ, যা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী জনগণের এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।”

রায় দিয়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ফারাহ মাহবুব বলেন, “আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটা বাতিল করিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বিধান বাতিল করা হল, যা ভবিষ্যতে কার্যকর হবে।”

তিনি বলেন, “১৪২ অনুচ্ছেদ বাতিল করার মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছাকে বাতিল করা হয়েছিল। যে কারণে ১৪২ পুনঃস্থাপন করা হল। সংশোধনীর বাকি বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হলো। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তা পরিবর্তন করা যেতে পারে।”

পূর্বাপর

এক যুগ আগে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে চলমান পরিস্থিতির উদ্ভব বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

যে সঙ্কটের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন ক্ষমতায়।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি। তারপর তিনটি নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই হয়েছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।

তার এক মাস আগেই সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল।

আপিল বিভাগের ওই রায়ের ভিত্তিতেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন করার কথা জানিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীনরা।

কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে যে তিনটি নির্বাচন হয়, তার সবগুলো নিয়েই ওঠে প্রশ্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত না এলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও মত দেয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ১৩ দিন পর গত ১৮ আগস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদাররা।

পরদিন ১৯ আগস্ট আদালত রুল দেয়। সেই রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

পরে এ রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসাবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণফোরাম ছাড়াও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যুক্ত হন। রুলের ওপর ৩০ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়।

এতে রিট আবেদনকারী সুজনের বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন, বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল শুনানি করেন।

অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষে রুলের ওপর শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী ছাড়াও অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থার পক্ষে একাধিক আনইজীবী শুনানিতে অংশ নেন।

শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষসহ অন্যান্য দলের পক্ষের আইনজীবীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেন।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বুকে ‘কুঠারাঘাত’ করেছে বলে শুনানিতে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত