চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বহু প্রতিক্ষীত ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
রবিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের আওতায় পিপিপির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াতে নতুন চারটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ওই চারটি টার্মিনালসহ এটা একটি মেগা প্রকল্প হবে।”
রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপদেষ্টা। এসময় পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন এবং পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প শক্তি বিভাগের সদস্য মো. রুহুল আমিনসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
একনেক বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বলেন, “বহুদিন ধরে এটা নিয়ে কাজ হচ্ছিল। কিন্তু কোনও অগ্রগতি হচ্ছিল না। এখন আমরা এটা শুরু করে দিচ্ছি।”
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ বা ৯ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা জোগান দেবে বিশ্ব ব্যাংক। বাকি প্রায় ৪ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা জোগান বেবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরির জন্য অবকাঠামো নির্মাণের গুরুত্ব তুলে বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে এবং আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে আরও ১৫ থেকে ২০ বছরে দেশের অর্থনীতির যে আকার ধারণ করবে এবং যে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্য হবে সেটার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে।”
তিনি জানান, চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের পাড় ঘেঁষে হালিশহরের পাশে বিশাল আকারের এই বে টার্মিনাল হচ্ছে।
কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে তার বর্ণনা দিয়ে পরিকল্পনা উপেদষ্টা বলেন, “এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমেই সমুদ্রের ঢেউ যাতে বন্দরে আসতে না পারে তার জন্য ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হবে। আর বন্দরের পেছনের অংশের পরিকাঠামো হিসেবে একটা হিন্টারল্যান্ড তৈরি করা হবে।”
তিনি বলেন, “এরপরে আসল যে জেটিটা হবে এবং সেখানে আসল যে বন্দর তৈরি হবে সেটা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) চুক্তির ভিত্তিতে হবে।”
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “এই প্রকল্পের আওতায় মোট চারটা টার্মিনাল হবে। প্রথম দুটি টার্মিনালের জন্য বিদেশি দুটি কোম্পানি প্রায় ঠিক হয়ে আছে। প্রথমটা করবে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান এন্টারপ্রাইজ অব সিঙ্গাপুর। তারা এখনই আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে। আর টার্মিনাল-২ করবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড।”
তিনি বলেন, “৩নং ও ৪নং টার্মিনাল কারা করবে সেগুলো এখনও ঠিক হয়নি। তবে এটুকু ঠিক হয়েছে এই দুটো টার্মিনালও পিপিপির ভিত্তিতেই হবে। তবে চুক্তির শর্ত কী হবে, কত বছরের জন্য পরিচালনা করবে- এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রকল্পটির ব্যয় এবং অর্থনৈতিক লাভের বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “এই ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয় বহুল এবং এজন্য অনেক সময় লাগে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছয় বছর বলা হচ্ছে। কিন্তু এরপরে আসল পোর্টটা যখন তৈরি হবে তাতে আরও সময় লাগবে।”
এসময় তিনি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বেশি প্রকল্প নেওয়া ঠিক না উল্লেখ করে বলেন, “যতদূর প্রয়োজন তার থেকে বেশি হয়ে গেলে কিন্তু এতো ব্যয় হুল মেগা প্রকল্প নেওয়া ঠিক না। আবার যদি শুরু না করা হয় তাহলে দেখা যাবে যখন অর্থনীতি আরও বড় হবে তখন এটার অভাবেই অর্থনীতি আর সমৃদ্ধি লাভ করতে পারছে না।”
“এটা সবসময় অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা,’ যোগ করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অর্থ জোগানের ঝুঁকি থাকলেও এই প্রকল্প সম্ভাবনাময়। এই প্রকল্প আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পরে দেশের অর্থনীতির জন্য বিশাল সক্ষমতা বয়ে আনতে পারে।
একনেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ১৬ প্রকল্প অনুমোদন
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন জানান, বৈঠকে বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’সহ মোট ১৬টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া হবে ৭০ শতাংশ বা ১৬ হাজার ৭১৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে ১১ শতাংশ বা ৩ হাজার ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী এবং উদ্যোগী সরকারি সংস্থাগুলো দেবে বাকি ১৯ শতাংশ বা ৪ হাজার ৪২৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
বৈঠকে বে-টার্মিনাল প্রকল্প ছাড়া অনুমোদন পাওয়া অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে-
>> জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় মাল্টি সেক্টর (২য় সংশোধিত) প্রকল্প; ব্যয় বেড়েছে ৩৯৪ কোটি টাকা।
>> বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি, ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস, অ্যান্ড রেসপন্স প্রজেক্ট; ব্যয়-২৬০ কোটি টাকা।
>> চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প (১ম পর্যায়) (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।
>> সবার জন্য বাসযোগ্য শহর তৈরি প্রকল্প; ব্যয় ৭৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
>> চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প; ব্যয় ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।
>> বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণ প্রকল্প; ব্যয় ১০৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
>> বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি, ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট; ব্যয় ১ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।
>> এগ্রিকালচারাল সিস্টেম রিস্টোরেশন কম্পোন্যান্ট প্রকল্প; ব্যয় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
>> টেকনিক্যাল সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট ইনভেস্টমেন্ট টুয়ার্ডস এগ্রিকালচার সেক্টর ট্রান্সফরমেশন প্রোগ্রাম অব বাংলাদেশ, প্রজেক্ট; ব্যয় ৫৩ কোটি টাকা।
>> বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্রজেক্ট; ব্যয় ২৬০ কোটি টাকা।
>> গ্রিন রেলওয়ে পরিবহন প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা প্রকল্প; ব্যয় ৯৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
>> তিতাস ও বাখরাবাদ ফিল্ডে ২টি গভীর অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্প; ব্যয় ৭৯৮ কোটি টাকা।
>> বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের খনন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প; ব্যয় ১২২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
>> স্ট্রেনদেনিং সোশ্যাল প্রটেকশন ফর ইম্প্রোভড রেজিলিয়েন্স, ইনক্লুসন অ্যান্ড টার্গেটিং প্রকল্প; ব্যয় ৯০৪ কোটি টাকা।
>> সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) (৪র্থ সংশোধিত) প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়নি। মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
>> ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সার্পোট প্রজেক্ট-২ (এফএসএসপি-২)-এর আওতায় প্রজেক্ট প্রিপারেশন অ্যাডভান্স (পিপিএ) প্রকল্প; ব্যয় ৮৭ কোটি টাকা।