Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

একাত্তরের নৃশংসতা : জেনোসাইড না গণহত্যা

একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে নানা কর্মসূচি চলছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে ২৫ মার্চ পালিত হয় গণহত্যা স্মরণ দিবস।
একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে নানা কর্মসূচি চলছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে ২৫ মার্চ পালিত হয় গণহত্যা স্মরণ দিবস।
[publishpress_authors_box]

একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞে নেমেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে যার শুরু হয়, নয় মাসে হত্যা করা হয় ৩০ লাখ বাঙালিকে। এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল গোটা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া।

পাকিস্তানি বাহিনীর এই বর্বরতাকে গণহত্যা হিসাবেই দেখা হয়ে আসছে বাংলাদেশে। ২০১৭ সালে সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাবও সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আনা প্রস্তাবটি ছিল এমন- “সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।”

তবে একাত্তরে বাঙালিদের ওপর চালানো নৃশংসতার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায়ে যারা কাজ করছেন, তারা এই ঘটনাটিকে গণহত্যার পরিবর্তে জেনোসাইড বলার পক্ষপাতি।

তাদের ভাষ্য, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী যা করেছিল, তাকে গণহত্যা বললে নৃশংসতার মাত্রা স্পষ্ট হয় না। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার অভিযানে নেমে গণহত্যা চালিয়েছিল, ফলে তা আদতে জেনোসাইড।

গণহত্যা কী

বাংলা শব্দ গণহত্যার ইংরেজি খুঁজলে পাওয়া যায় ম্যাস মার্ডার, ম্যাস কিলিং বা ম্যাসাকার। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি ঘটনায় একটি স্থানে একবারে যদি তিন বা তার বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়, সেটাই গণহত্যা।

জেনোসাইডের জন্য আলাদা কোনও বাংলা শব্দবন্ধ নেই। ফলে জেনেসাইডের মতো ঘটনাও গণহত্যা হিসাবেই বাংলায় বোঝানো হচ্ছে।

জেনোসাইড কী

জেনোসাইড লাতিন শব্দবন্ধটির দুটি অংশ; জেনোস বা জাতি ও সাইড বা হত্যা। রাফায়েল লেমকিন নামে এক পোলিশ নাগরিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনকে বোঝাতে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন বলে এনসাইক্লোপিডিয়ায় ব্রিটানিকায় পাওয়া যায়। লেমকিন পরে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে জার্মানদের বিচারে আমেরিকার হয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নেতা এডলফ হিটলার ইহুদি জাতিকে পৃথিবী থেকে নির্মূলে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে নেমেছিলেন, সাত বছরে খুন করা হয়েছিল ৬০ লাখ ইহুদিকে। যাকে এক কথায় হলোকাস্ট বলা হয়।

পরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলার পক্ষে প্রচারে নেমেছিলেন লেমকিন। তার যুক্তি ছিল- জেনোসাইড একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য- এটি স্রেফ গণহত্যা নয়।

ঐতিহাসিক নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তা প্রমাণ করেন। তার জোরাল প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে প্যারিসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ‘দ্যা কনভেনশন অব দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অফ দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’ গৃহীত হয় যা জেনোসাইড কনভেশন নামে পরিচিত।

একটা জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংগঠিত কার্যক্রমগুলো ‘জেনোসাইড’ হিসাবে স্বীকৃতি পায়। রাজনৈতিক কারণে যত বেশি সংখ্যক হত্যাকাণ্ডই ঘটুক না কেন, সেটি গণহত্যা হতে পারে, কিন্তু জেনোসাইড নয়।

একাত্তরে বাঙালির ওপর চালানো সেই নৃশংসতাকে জেনোসাইড হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি-সংগঠন কাজ করছেন এখন। আর তাতেই গণহত্যা না জেনোসাইড, তা নিয়ে প্রশ্ন সামনে আসছে।

একাত্তরের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’য়ে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। নয় মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল।

কার কী মত

শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তান, প্রজন্ম ৭১ এর সভাপতি আসিফ মুনীর জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহারে পক্ষপাতি।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেকে মনে করতে পারে বাংলায় গণহত্যা ব্যবহার করছি না কেন? গণহত্যা বললে মনে হয় গণহারে হত্যা। জাতিকে টার্গেট করে ইতিহাস-সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা তো জেনোসাইড।”

একাত্তরে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে একে জেনোসাইড বলাই সঙ্গত বলে মনে করেন তিনি।

গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক শব্দের চেয়ে উপলব্ধিটাকেই প্রাধান্য দিতে চান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে আসলে উপলব্ধিটাই বড়। গণহত্যা বললে নৃশংসতার মাত্রাটা বোঝায় না ঠিক। দুটোই একসঙ্গে ব্যবহার করা যায়। না হলে জেনোসাইড শব্দটা ব্যবহার করা যায়। আমরা আসলে অদল-বদল করে দুটোই বলতে পারি।”

জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়ার ক্ষেত্রে আবার জেনোসাইড ব্যবহারই সঙ্গত বলে মফিদুল হক স্বীকার করেন।

জেনোসাইড বলার পক্ষে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জনও।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মানুষ হত্যা না করেও জেনোসাইড করা যায়।”

বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে, তা পরিবর্তন করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

“সেটা সংশোধন করে জেনোসাইড দিবস বলা উচিৎ। সরকারে কাছে আমরা প্রেজেন্টেশন কিংবা রাইটআপ তুলে ধরব, যাতে জেনোসাইড দিবস পালন করা হয়।”

গণহত্যা বা জেনোসাইড দুটোই চলতে পারে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তবে বাংলায় জেনোসাইড বলতেও তার আপত্তি নেই।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর চালানো গণহত্যাকে বলা হয় হলোকাস্ট। হলোকাস্টকে হলোকাস্ট বলা যেতে পারলে আমরা বাংলায় জেনোসাইড বলতে পারি।”

প্রতিবছরই মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ করা হয় ২৫ মার্চের কালরাত।

প্রশ্ন আসছে, বাংলায় জেনোসাইডের প্রতিশব্দ কি খোঁজা হবে?

অধ্যাপক কার্জন মনে করেন, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এর বাংলা শব্দ একটা বের করা দরকার।

“তা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা জেনোসাইডই বলব।”

ভাষাবিজ্ঞানীরা যদি জেনোসাইডের উপযুক্ত বাংলা শব্দ বের করতে পারেন, তা ব্যবহারে কোনও আপত্তি নেই শাহরিয়ার কবিরের।

তবে তিনি বলেন, “লাগসই শব্দ চয়ন করতে হবে। তা যেন অর্থ পরিবর্তন না করে ফেলে।”

শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর বলেন, “গণহত্যা বললে ম্যাস কিলিং বোঝায়। গবেষকরা বাংলা প্রতিশব্দ চিন্তা করতে পারেন। যতদিন একটা বাংলা শব্দ না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন দেশের কথা চিন্তা করে জেনোসাইড শব্দ ব্যবহার করা উচিৎ।”

জেনোসাইড বোঝাতে নতুন একটি বাংলা শব্দ হতে পারে বলে মত দেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। তিনি মনে করেন, নতুন শব্দ গণহত্যা না জেনোসাইড, সেই বিতর্কের সমাধান দিতে পারে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সোশ্যাল লিঙ্গুয়েস্টিকের একটা ধারণা আছে। শব্দ একটা অর্থ তৈরি করে দেয়। এই অর্থে গণহত্যা হিসেবে তুলনা করতে পারে।

“একটা লাগসই- যুৎসই শব্দ তৈরি করা যেতে পারে। শুধু করলেই হবে না, তা ব্যাপকহারে প্রচার করতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা পরিভাষা নিয়ে কাজ করে, বাংলা একাডেমি, এটা তাদের দায়িত্ব।”

তবে জেনোসাইডের বাংলা পরিভাষা যে তৈরি করতেই হবে, তেমনটা মনে করেন না বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কম্পিউটার শব্দের বাংলা কি আপনি করেছেন? অনেক শব্দ রয়েছে, যেগুলোর আমরা বাংলা করিনি। জেনোসাইড অনেক প্রচলিত শব্দ। তাই এর বাংলা করার বিষয়টি আমরা আপাতত ভাবছি না।”

তবে যারা ভাষাবিদ আছে, তাদের নিয়ে বিষয়টি আলোচনা-পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত