Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

পাগলা ঘণ্টা, যার আওয়াজে প্রতিরোধ পর্বের সূচনা

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সদস্যদের স্মরণে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সদস্যদের স্মরণে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ।
[publishpress_authors_box]

২৫ মার্চ, ১৯৭১; রাত তখন ১১টা ৩৫ মিনিট; পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনে, সচকিত হয়ে উঠল সব পুলিশ সদস্য। জড়ো হলো অস্ত্রাগারের সামনে, হাতে তুলে নিল অস্ত্র। শুরু হলো প্রতিরোধ লড়াই।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ। ভারী অস্ত্রের সামনে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে সেই রাতে লড়েছিল পুলিশ সদস্যরা। বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি, তখন অস্ত্রসহ সটকে পড়েছিল। পরে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে।

পাগলা ঘণ্টার চল এখন আর নেই। তার জায়গা নিয়েছে ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম। তবে রাজারবাগের পাগলা ঘণ্টাটি ইতিহাসের অংশ হয়ে স্থান করে নিয়েছে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

ঘণ্টা বলতে এটা একটা বড় লোহার দণ্ড, আরেকটি পাত দিয়ে তা বাজানো হয়ে থাকে।

জাদুঘরের ঘণ্টাটির পাশে লেখা আছে- রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করতে তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষী কনস্টেবল আব্দুল আলী অস্ত্রাগারের পাগলা ঘণ্টা পিটিয়ে সবাইকে একত্রিত করেছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলী পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাইকে আসা এক যুবক রাজারবাগে এসে তাকে জানান যে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সব পুলিশ সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

একজন সাধারণ কনস্টেবল হয়ে কী করে এই খবর সবাইকে দেবেন, তা নিয়ে শুরুতে ভাবনায় পড়েছিলেন তিনি। তবে ক্ষণিকের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, কী করতে হবে তাকে। ছুটে যান অস্ত্রাগারের সামনে, বাজিয়ে দেন পাগলা ঘণ্টা।

এই ঘণ্টা বাজালে পুলিশ সদস্যরা যে যেখানে থাকুক না কেন, ছুটে আসবে, সেটা জানতেন আব্দুল আলী। তা ঘটেছিলও।

এই পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সহকর্মীদের সতর্ক করেছিলেন আব্দুল আলী।

অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রির রাইফেল দিয়ে গুলি করে তালা ভেঙে নিজেরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতে নেয় পুলিশ সদস্যরা। তারপর পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে, ব্যারাক ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।

তার আগে রাত ১১টার পরপরই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ঘিরে ফেলেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান। উত্তাল সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যদের বুঝতে বাকি ছিল না, কেন এসেছে সেনাবাহিনী। কারণ ততক্ষণে ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের খবর জেনে গিয়েছিল তারা।

তখন জেলা ও সাব ডিভিশনগুলোতে পুলিশ বেতার মারফত খবরটি জানানোর দায়িত্ব এসে পড়েছিল কনস্টেবল শাহজাহান মিয়ায় কাঁধে। তাৎক্ষণিক একটি বার্তা তিনি পাঠিয়ে দেন।

সেই বার্তাটি ছিল- “Base for all station of east Pakistan police, keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself, over ”

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে, তখন সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলই ছিল একমাত্র ভরসা। ট্যাংক, মর্টার আর মেশিনগানের সঙ্গে রাত ৩টা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা।

তার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন, “২৫ মার্চের রাত ১০টার দিকে পুলিশ বিদ্রোহ করে এবং পুলিশ লাইনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আর্মির ওপর প্রথম গুলিবর্ষণ শুরু করে। রিজার্ভ পুলিশ কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাদেরকে রাত ৩টার মধ্যে নিরস্ত্র করা হয়।”

সেই রাতে প্রায় আটশ সেনা ট্যাংকবহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢুকেছিল। তাদের হাতে হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য নিহত হয়। সকাল হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর আট-দশটা ট্রাক ঢোকে পুলিশ লাইন্সে। ট্রাকগুলোতে করে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক প্রকাশনায় লেখা হয়েছে, “বাঙালি পুলিশের কিছু সদস্য বুকে অসীম সাহস নিয়ে সমান তালে লড়ে চলে ট্যাংক, কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে। অন্য একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ-চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিনকার সেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে সারাদেশে, সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে এবং সন্মুখ সমরে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের যুদ্ধ তারাই ছড়িয়ে দেয় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে।”

৭ মার্চ থেকে চলছিল প্রস্তুতি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নীরব প্রস্তুতি নিতে থাকে পুলিশ সদস্যরা। সে সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ১৯ জন সুবেদার এবং ১৪ জন সার্জেন্ট ছিলেন অবাঙালি। যার ফলে গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন ছিল বাঙালি পুলিশদের জন্য।

অনেক সতর্কতার সঙ্গে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিলেন। সে সময় বাঙালি পুলিশ সদস্যরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারের সামনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকাও তুলেছিলেন।

১৬ মার্চ ঘটে আরেক ঘটনা। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করতে বেলা ১১টায় গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কালো পতাকাধারী কোনও গাড়ি প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকেছিল।

বঙ্গবন্ধুর গাড়ি প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢোকার সময় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে তাকে অভিবাদন জানায়। পুলিশ সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছিল।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের আইজি তসলিম উদ্দিন আহমেদ ও বিশেষ শাখার ডিআইজি এ এস মেজবাহ উদ্দিন ৩২ নং সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন, “আমরাই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। সুতরাং আমাদের নির্দেশ মেনে চলাই আপনাদের উচিৎ হবে।” জবাবে বিশেষ শাখার ডিআইজি এ এস মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে আপনাদের প্রতি আমাদের অবশ্যই পূর্ণ আনুগত্য রয়েছে।”

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই চূড়ান্ত বলে তখন মেনে নিতে তৈরি ছিল পুলিশ সদস্যরা।

রাজারবাগে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রয়েছে একাত্তরের অনেক স্মারক।

পুলিশ সঙ্গে নেই, জানত পাকিস্তানিরা

পাকিস্তানি বাহিনী জানত, পুলিশ তাদের পক্ষে নেই। তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানের জেনারেল রাও ফরমান আলীর বইয়ে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় পুলিশের তৎকালীন আইজি তসলিম উদ্দিন আহমেদের উপর ছিল পাক বাহিনীর ক্ষোভ।

রাও ফরমান আলীর লেখা ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, “পুলিশ প্রধান সবার আগে তার বাহিনীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ কমান্ডের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছিলেন।”

অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় পাক সেনা কর্মকর্তারা প্রশাসনিকভাবে চরম অসহায়ত্ব বোধ করতে থাকেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে আসা সৈন্যরা এ দেশের রাজনীতিকদের যেমন চিনত না, তেমনি পথঘাটও তাদের চেনা-জানা ছিল না। বাঙালি পুলিশ সদস্যদের পরিকল্পিত প্রশাসনিক অসহযোগের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জেনারেল রাও ফরমান আলীর লেখায় বিষয়টি স্পষ্ট।

তিনি লিখেছেন, “আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছিলাম যে, রক্তপাত এড়াতে হলে প্রয়োজনে কূটচাল খাটিয়ে হলেও সকল রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের সকল উল্লেখযোগ্য নেতার একটি তালিকা তৈরি করে সেসব স্থানে যাওয়ার এবং তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য বিভিন্ন দলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম।

“প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের ফলে পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে যায় এবং নেতারাও অদৃশ্য হয়ে যান। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্য কোনও নেতাকেই গ্রেপ্তার করা সম্ভবপর হয়নি।”

২৬ মার্চের পরই তসলিম উদ্দিন আহমেদকে আইজি পদ থেকে সরিয়ে অবাঙালি মোজাফ্‌ফর আহমেদ চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার।

তবে শেষ রক্ষা হয়নি, নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি, আর তাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে লড়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য এই অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত