কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার দুই শিক্ষার্থীকে ঢাকার শাহবাগ থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকরা।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ ঘুরে নিপীড়নবিরোধী ছয় শিক্ষকের একটি দল শাহবাগ থানার সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে শিক্ষকরা থানায় প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। এ সময়পুলিশের সঙ্গে শিক্ষকদের খানিক বাকবিতণ্ডা হয়।
পরে শিক্ষকদের দলটি থানায় ঢুকে দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনেন। এই দুই শিক্ষার্থীকে বিনা অপরাধে থানায় আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
ছাড়া পাওয়া দুই শিক্ষার্থী হলেন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২২- ২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইংরেজী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শরীফুল হাসান।
থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার পর এই দুই শিক্ষার্থীকে নিয়ে শিক্ষকরা অপরাজেয় বাংলায় নিপীড়নবিরোধী সমাবেশ করেন।
ছাড়া পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাবি শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, “কাল (মঙ্গলবার) দুপুরের পর থেকে আমাকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি। তারা আমাকে রাত ২টা পর্যন্ত রমনা থানায় রেখেছিল। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। আমি এক সুযোগে ডাক্তারকে দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।”
কাঁদতে কাঁদতে এই শিক্ষার্থী বলেন, “আমি বের হতে পেরেছি এটাই অনেক বেশি। শিক্ষকদের প্রতি আজীবন সম্মান থাকবে।”
চবি শিক্ষার্থী শরীফুল হাসান জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রাতে হামলা হলো সেদিন মারামারি থামাতে গিয়ে তিনি আহত হন। পরে ট্রেনে করে ঢাকায় আসেন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “মারামারি দেখে ক্ষোভ থেকে আমি ঢাকায় আসছি। প্ল্যাকার্ড নেব একটা, এ জন্য নীলক্ষেতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। পরে তিন নেতার মাজারের ওখানে নামাজ পরে দোকানে চা খাচ্ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে আটক করা হয়।”
দুই শিক্ষার্থীকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে যাওয়া শিক্ষকদের একজন ঢাবি আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিকভাবে হামলা হয়নি। দুটো ছাত্রকে কোনও অভিযোগ ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছে। এটা অনেক বড় একটা মেন্টাল টর্চার।”
তিনি বলেন, “যারা গুলি করে মানুষ মারে তাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারছে না। যারা আক্রান্ত হয় তাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে– এটাই হয়ে গেছে বাংলাদেশের চেহারা।”
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, “এ দেশে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা চালানো হয়েছে, ৬টা প্রাণ ঝড়ে গেছে– এ রকম একটা পরিস্থিতিতে যখন আমরা এসে দাঁড়িয়েছি তখন সিন্ডিকেটগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়ার।”
তিনি বলেন, “আমরা জানি, আমরা বুঝতে পেরেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। আপনাদের বন্ধ করার যদি এতই ক্ষমতা থাকে তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে কেন ব্যর্থ হলেন?”
স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কথায় বন্ধ হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, “সারাদেশে যা ঘটছে যেভাবে ঘটছে এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। ঠান্ডা মাথায় রংপুরের ছেলেটাকে গুলি করা হয়েছে। এ রকম মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে আমরা কীভাবে স্বাভাবিক থাকি।”
তিনি বলেন, “এই ছেলেমেয়েদের দোষ দেবেন কীভাবে? এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। সর্বত্র কোটা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দল থেকে শিক্ষক হবে। দলের হলে ভিসি হওয়া যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় না?”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা খুব বাজে সময় পার করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুব বীভৎস অবস্থা। সেই বীভৎস অবস্থার বিরুদ্ধে মানুষ যে দাঁড়াতে পারে, সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যেই চেতনা নিয়ে ব্যবসা করা হয় তার বিপরীত এবং প্রকৃত চেতনা এটা। যে চেতনা দিয়ে বাংলাদেশ বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিল, তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হলো কেন? আমাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। যারা আমাদের ছেলেমেয়েকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, যারা বৈষম্য চান, তারা সেই রাজাকারদের আদর্শেই লালিত।”
গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার পর কোটাবিরোধী বিক্ষোভ থেকে সহিংসতা ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। তাতে মঙ্গলবার অন্তত ছয়জন নিহত এবং বহু আহত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়েছে।
দিনভর সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মঙ্গলবার ঢাকাসহ ছয় জেলায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
সংঘাত-সহিংসতায় প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর বুধবার সিটি করপোরেশন এলাকাভুক্ত প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত এসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বুধবার দুপুরে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা ঢাবির টিএসসিতে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।