Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা

সবার ছিল সাজা, এখন সবাই হলো খালাস

তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টু।
তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টু।
[publishpress_authors_box]

সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার আসামি সাবেক আরেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে; বিরল এই ঘটনা ঘটেছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায়; বিচারিক আদালতে সব আসামিরই দণ্ড হয়েছিল, কিন্তু আপিলের রায় খালাস পেল সবাই।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের এই হামলার বিচার শুরু হয়েছিল এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে, এরপর আওয়ামী লীগ আমলে বিচারিক আদালতে রায়ের পর আপিলের রায় হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে।

রবিবার হাই কোর্টের সেই রায়ে সম্পূর্ণ উল্টে যায় বিচারিক আদালতের রায়; উচ্চ আদালত বলেছে, ছয় বছর আগে বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ ছিল, কারণ তা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি।

আর এই রায়ে দায়মুক্ত হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তাদের সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৪৯ আসামি।

পুলিশ বাহিনীর সাবেক আটজন কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর সাবেক পাঁচজন কর্মকর্তার পাশাপাশি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ২৯ জনও খালাস পেয়ে গেছেন এই রায়ে।

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন পেরিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসায় এখন ন্যায়বিচার হয়েছে বলে প্রতিক্রিয়া এসেছে বিএনপির কাছ থেকে। যুক্তরাজ্য থেকে তারেকের এখন দেশে ফেরার ইঙ্গিতও দিয়েছেন দলটির নেতারা। অন্যদিকে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভয়াবহ সেই হামলার বিচারের ভার জনগণের ওপর দিয়েছে।

বিচারিক আদালতের পর হাই কোর্টের রায় হলেও এখানেই শেষ হচ্ছে না দেশের ইতিহাসের আলোচিত এই মামলা। আপিল হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে আপিল বিভাগ। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, আপিল করবেন কি না?

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হয়েছিল সেই গ্রেনেড হামলা। তাতে দলটির ২৪ নেতা-কর্মী-সমর্থক নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়।

বিএনপি সরকার আমলে প্রশ্নবিদ্ধ তদন্তের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শুরু হয়েছিল এর বিচার। পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে তারেকসহ আরও ৩০ জনের নাম যুক্ত হয় আসামির তালিকায়।

এরপর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ৪৯ আসামিকে দণ্ড দিয়ে রায় দেয়। তিন আসামির অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তারা বাদ পড়েন এই মামলায়।

বিচারিক আদালতের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করে। সেই আবেদন এবং মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) শুনানির পর ছয় বছর বাদে হাই কোর্টের রায় দিল।

সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি

কোন বিবেচনায় সবাই খালাস

আপিলের রায়ে উচ্চ আদালত বলেছে, বিচারিক আদালতের রায়টি সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি।

যে যুক্তিতে সবাইকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট, তা রায়ের পর সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

তিনি বলেন, “রুল যথাযথ ঘোষণা করে সকলকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। (রায়ে) বলা হয়েছে, নিম্ন আদালত যে ট্রায়ালটা করেছে, এই ট্রায়ালটা ছিল অবৈধ, কারণ আইনের ভিত্তিতে এই ট্রায়ালটা সংঘটিত হয় নাই।

“এবং এটাও বলেছেন, কোনও সাক্ষীর সঙ্গে কোনও সাক্ষীর কোলাবরেশন নাই। শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। এজন্যই সকলের আপিল একসেপ্ট করে, ডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট করে সকল আসামিকে খালাস দিয়েছেন। তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সকলকেই এই মামলায় বেকসুর খালাস দিয়েছেন।”

হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “কোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেছে, এই মামলায় সাক্ষীদের পরস্পর কেউ দেখেছে, কেউ সচক্ষে দেখেছে, এ ধরনের কোনও এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা টর্চার করে নেওয়া হয়েছে।

“এ মামলায় মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা সাবমিশনে বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া হয়, তার কোনও নজির নেই। আজকে আদালত বলছেন, দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি যেটা করেছিলেন, এটাও পরবর্তীতে তিনি প্রত্যাহার করেছেন। এজন্য এই স্বীকারোক্তির আইনগত কোনও মূল্য নেই।”

এই বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির আইনজীবী কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, একই মামলায় দুটি অভিযোগপত্র এবং মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রায়ে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মামলায় তারেককে আসামি করা হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আব্দুল কাহার আকন্দকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে তার চার্জশিটে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

“আদালত বলেছেন, মুফতি মান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে যে চার্জশিট দেওয়া হয়, সেই চার্জশিটটি আইন পরিপন্থি ছিল। ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইনে এই চার্জশিটের আইনগত ভিত্তি নেই। এজন্য আসামিদের খালাস দিয়েছেন।”

২০০৮ সাল থেকে এ মামলায় আসামিদের পক্ষে লড়ে আসছেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। দীর্ঘ লড়াইয়ে এখন ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।

অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটি সাক্ষ্য এবং আইনের কোনও দিক থেকেই প্রমাণিত হয়নি।

আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “কোনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না। একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে দণ্ডবিধির ১২০ (খ) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তি) প্রমাণ করা যায় না। আর সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ষড়যন্ত্রকারীর কথা বা কার্য স্বাধীন হতে হবে।”

মুফতি হান্নানের প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাবি করে তিনি বলেন, “দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ অন্যান্য যাদের আসামি করা হলো, তাদের বেলায়ও দেখা গেছে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। দুটি জবানবন্দিই মুফতি হান্নান প্রত্যাহার করে গেছেন। ফলে প্রত্যাহার করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়া যায় না। এমনকি যে আসামি স্বীকারোক্তি করেছে উনি যদি বেঁচে থাকতেন, তারপরও এটা প্রযোজ্য হত না।”

আদালত রায়ে দ্বিতীয় অভিযোগপত্র বেআইনি ঘোষণা করেছেন জানিয়ে শাহজাহান বলেন, “দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নিয়ে আইনের যে বিধান আছে, অফিসার ইনচার্জ নতুন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আনা হয়েছে পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনে।”

ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে না নিলে দায়রা আদালতে সরাসরি অভিযোগপত্র দাখিল করা যায় না। এখানে এই কার্যবিধির ১৯৩(১) ধারা পালন করা হয়নি বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান।

তিনি বলেন, “পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত যখন মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পাঠালেন, পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আসার পর সেই অভিযোগপত্র আবার কোনও ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেননি। সরাসরি এটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়, মহানগর দায়রা আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে আমলে নিয়েছেন। হাইকোর্ট রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩(১) ধারা অনুসরণ করা হয়নি।”

এ মামলায় কোনও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না দাবি করে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, “২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি, আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে, প্রকৃত খুনি কে সেটি নাই। এক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।”

মামলার অভিযোগপত্র, আসামির দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকার পরও সর্বোচ্চ সাজাসহ অন্যান্য দণ্ড দেওয়ায় বিচারিক আদালতের রায়টি হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যারা আপিল করেননি, তাদেরসহ হাই কোর্ট সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন।

“ফলে তারেক রহমান, কায়কোবাদসহ যারা আপিল করেননি তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। মফস্বল আদালতে একটা কথা প্রচলিত আছে, নথিশুদ্ধ খালাস। এই মামলাটিও নথিশুদ্ধ খালাস হয়েছে।”

ঢাকা মহানগর জজ আদালত।

কী ছিল বিচারিক আদালতের রায়ে

বিচারিক আদালতের রায়টি দিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন। তিনি পরে হাই কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পান।

রায়ে তিনি বলেছিলেন, এই গ্রেনেড হামলা ছিল ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।

“রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়,” বলেছিলেন তিনি।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে।

এই ষড়যন্ত্রের পেছনে তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল বলে অভিযোগে বলা হয়েছিল।

আদালতে উপস্থাপিত জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। ওই পরিকল্পনা হয়েছিল ‘হাওয়া ভবনে’, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল তারেক রহমানের হাতে।

ট্রাইব্যুনালে রায়ে বিচারক ৪৯ আসামির সবাইকে সাজা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাবর, পিন্টুসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড, তারেকসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বাকি ১১ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।

দণ্ডিতদের মধ্যে তারেকসহ ৭ জন রাজনীতিক, ৮ জন পুলিশ, ৫ জন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ২৯ জন জঙ্গি ছিলেন।

এই মামলার রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান আসামি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি ছিল আলোচিত। তবে এই রায়ের আগেই অন্য মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল।

২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে থাকা তারেককে পলাতক দেখিয়েই এই বিচার হয়।

এখন কী করবে রাষ্ট্রপক্ষ

আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানকে দেখা যায়নি। তবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার উপস্থিত ছিলেন।

তবে পরে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, হাই কোর্টের দেওয়া এ রায়ের কারণ ও নির্দেশনা দেখে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

“রায়ের কারণ দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপিল করা উচিৎ বলে মনে করি।”

গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনকালে চাপে থাকা বিএনপি এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।

হাই কোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, “তারেক রহমান সাহেব আজকের এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন।

“আজকে প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তারেক রহমান সাহেবকে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেই মামলায় আইগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।”

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের পক্ষে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “ন্যায়বিচারের জন্য বিএনপি দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনের প্রতিফলন হয়েছে আজ। হাইকোর্টের রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে এই মামলায় ন্যায়বিচার হয়নি।”

অন্যদিকে হাই কোর্টের দেওয়া রায় প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দলটির ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, “ইউনূসের ক্যাঙ্গারু কোর্ট নয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার করবে বাংলাদেশের জনগণ।”

আওয়ামী লীগের এক বিবৃতিতে বলা হয়,  “একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডিত সকল আসামিকে সংবিধান, আইন ও সকল বিচারিক রীতিনীতি লংঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে খালাস করে বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে (বর্তমান সরকার)।

“বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনে করে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি একটি জঘন্য ও ঘৃণ্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”

ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, “একুশে আগস্ট মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত ৪৯ জন আসামির সকলকে খালাস করে এই অসাংবিধানিক ও অবৈধ তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার পবিত্র সংবিধানের ওপর কুঠারাঘাত করল।”

বিএনপির শাসনকালে এই হামলার ঘটনাটি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ বলেছে, “২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি- জামাত জোট সরকারের নির্দেশে তদানীন্তন পুলিশ এই মামলা গ্রহণ করেনি। এই ভয়ানক গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধের হীন উদ্দেশ্যে তারা জজমিয়ার নাটক সাজিয়েছিল। পরবর্তীতে এক এগারোর সরকারের সময় ২০০৭ সালে এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুনভাবে তদন্ত শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আদালতের কাজে দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ন্যায়বিচারের সকল আইনি ও বিচারিক বিধি বিধান ও রীতিনীতি প্রতিপালন করে এই মামলার বিচার সম্পন্ন করে।

“অসাংবিধানিক ও অবৈধ তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে হাইকোর্টের একটি বিভাগ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও বেআইনিভাবে বিচারিক আদালতের রায় উদ্ভূত ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে একুশে আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড হামলার বিচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই প্রহসনমূলক রায় দেয়।”

চার মাস আগে অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছেড়ে এখন ভারতে রয়েছেন শেখ হাসিনা। তার কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

দণ্ডিত ছিলেন কারা কারা

আলোচিত এই মামলায় ৭ রাজনৈতিক নেতা, ৮ পুলিশ কর্মকর্তা, ৫ সামরিক কর্মকর্তা ও ২৯ জঙ্গি, অর্থাৎ ৪৯ জনকে সাজা দিয়েছিল বিচারিক আদালত; তারা সবাই এখন খালাস পেলেন।

খালাস পাওয়া বিএনপির ৭ নেতা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সালাম পিন্টু, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা ও হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ও বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ।

বিচারিক আদালতে তারেক রহমান, কায়কোবাদ ও হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আর বাবর, পিন্টু ও হানিফকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

খালাস পাওয়া ৮ পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- সাবেক আইজিপি খোদা বকশ চৌধুরী, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসান, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ।

সাবেক তিন আইজিপির মধ্যে খোদা বকশ চৌধুরীর ৩ বছর এবং শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদার ২ বছর কারাদণ্ড হয়েছিল। ওবায়দুর রহমান, খান সাঈদ হাসানের ২ বছর, রুহুল আমিন, আতিকর রহমান ও আবদুর রশীদের ৩ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

খোদা বকশ চৌধুরী ড. ‍মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বিশেষ সহকারীর পদে রয়েছেন।

খালাস পাওয়া সামরিক বাহিনীর ৫ কর্মকর্তা হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহীম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এ টি এম আমিন আহমদ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক।

তাদের মধ্যে রেজ্জাকুল ও আবদুর রহীমের মৃত্যুদণ্ড এবং আমিন আহমদ, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও সাইফুল ইসলাম ডিউককে ২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল।

হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি), লস্কর-ই-তাইয়েবা, হিযবুল মুজাহিদীন, তেহরিক-জিহাদি আল ইসলাম এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন এ পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনের ২৯ জনের সাজা হয়েছিল বিচারিক আদালতের রায়ে।

সেই রায়ে হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসাবে হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান এবং একই সংগঠনের নেতা মাওলানা তাজউদ্দীনের সস্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছিল। তাজউদ্দীন সাবেক উপমন্ত্রী সালাম পিন্টুর ভাই।

বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হওয়া ১৪ জঙ্গির হলেন- মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, রফিকুল ইসলাম ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, কাশ্মিরী নাগরিক আবদুল মাজেদ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে ফরিদ ও মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৫ জঙ্গি হলেন- শাহদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, আরিফ হাসান সুমন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান, মহিবুল মোত্তাকিন, আনিসুল মোরসালিন, মো. খলিল, মো. ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি আবদুল হাই ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু।

এই মামলায় যে তিন আসামির রায়ের সময় বাদ পড়েন, তারা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল, জোট সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মো. মুজাহিদ, হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও বিপুল।

এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। মুফতি হান্নান ও বিপুলকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ঝালকাঠির বিচারক হত্যা মামলায়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়।

শুনানি হলো কত বছর

ঘটনার চার বছর পর তদন্ত শেষে ২০০৮ সালে মামলার প্রথম অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন সিআইডির কর্মকর্তা ফজলুল কবির। তারপর অধিকতর তদন্ত করেছিলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ।

তার প্রায় এক দশক পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় হয়। মোট ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায়টি দেওয়া হয়। এর বাইরে সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয় ২০ জনের।

তার দেড় মাস পর বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাই কোর্টে এসে পৌঁছায়, যা সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।

এরপর ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়।

দেড় বছর বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চে মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি করে প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল।

এ অবস্থায় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি পদত্যাগ করেন।

এরপর নতুন প্রধান বিচারপতি হিসাবে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর হাই কোর্ট বিভাগের বেঞ্চ পুনর্গঠন করেন তিনি।

পরে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ মামলা দুটি পাঠানো হয়। এ আদালতে গত ৩১ অক্টোবর এবং ৭, ১৪ ও ২১ নভেম্বর ৪ কাযবিদস মামলা দুটি শুনানির পর রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।

তদন্তে ছিল ‘জজ মিয়া নাটক’

কোনও ঘটনার তদন্তে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা কীভাবে হয়, গ্রেনেড হামলার মামলাটি তার জাজ্বল্যমাণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ের এক বছর বাদে দুদকের মামলায় ভুল আসামি জাহালমকে মুক্তি দেওয়া আগে হাই কোর্টের বিচারক বলেছিলেন, “জজ মিয়া নাটক আরেকটি বানালেন নাকি?”

‘জজ মিয়া’ ছিলেন একজন ভবঘুরে। ২০০৪ সালে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর তাকেই হামলাকারী হিসাবে দেখানো হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে।

হামলার ঘটনাটিকে ষড়যন্ত্র বলে প্রথমেই দাবি করেছিলেন বিএনপি নেতারা। তারা উল্টো আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছিল।

এরপর গ্রেপ্তার করা হয় শৈবাল সাহা পার্থ নামে এক তরুণকে। মোখলেসুর রহমান নামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে হালে পানি না পাওয়ার পর ২০০৫ সালে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় যুবক জজ মিয়াকে।

জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিও আদায় করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘বড় ভাই’দের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিল। সেই বড় ভাইরা হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল।

সেই জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি জজ মিয়াকে মুল আসামি ধরেই এগোতে থাকে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের কারণে সেই পথে বেশি দূর যেতে পারেনি।

হামলার পরদিনই মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করছিল, পরে ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি পায় তদন্তভার।

এরপর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে তদন্ত মোড় নেয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরকের দুই মামলায় অভিযোগপত্র দেন সিআইডির তৎকালীন সুপার ফজলুর কবীর। তাতে অব্যাহতি দেওয়া হয় জজ মিয়াসহ বিএনপি আমলে গ্রেপ্তার ২০ জনকে।

সেই অভিযোগপত্রে জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয়। রাজনীতিকদের মধ্যে তথন আসামি কেবল ছিলেন সালাম পিন্টু।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। এরপর সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনটি স্মরণ করে আসছে আওয়ামী লীগ, তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবছর তাদের কোনও কর্মসূচি ছিল না।

ভয়াবহ সেই হামলা

তখন ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট, সংসদে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা বের করার কর্মসূচি দেয়।

শোভাযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে। সেখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।

মঞ্চে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় অজানাই থেকে যায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত