গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার বহুল আলোচিত মামলাটি ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে হােইকোর্টে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন নতুন করে তদন্তের দাবি উঠেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হয়েছিল গ্রেনেড হামলা। তাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে এর তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার বিষয়টি পরে প্রকাশ পেয়েছিল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিআইডি অভিযোগপত্র দেওয়ার পর বিচার শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্ত শেষে দেওয়া হয়েছিল সম্পূরক অভিযোগপত্র। তাতে আসামির তালিকায় নাম যোগ হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের।
১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালতে মামলার রায় হয়। তাতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। তারেক রহমানসহ ১৯ জনের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
বিচারের প্রথম ধাপ পেরিয়ে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে মামলাটি। গত বছরই মামলাটি শেষ করার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন আইনজীবীরা।
কিন্তু তা আর শুরু হয়নি। এরমধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেড় দশক পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে। তারপর অ্যাটর্নি জেনারেলসহ উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রের সব আইন কর্মকর্তাও বদলে গেছে।
ডেথ রেফারেন্সসহ আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে রয়েছে মামলাটি।
গত ১৮ আগস্ট মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এলেও সময়ের আবেদন করে তা পিছিয়ে নিয়েছেন নতুন আইন কর্মকর্তারা।
আলোচিত এই মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের ভ্যাকেশনের (দেড় মাসের ছুটি) পর এ মামলা শুনানির জন্য আসবে।”
মামলাটি এখন যে বেঞ্চে আছে, ছুটির পর তাদের এখতিয়ার পরিবর্তন না হলে সেখানেই শুনানি হবে বলে তিনি জানান।
বিচারিক আদালতে রায়ের পর ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়।
২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি মামলায় আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক তৈরি হয়।
এরপর ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে বিজি প্রেস থেকে হাইকোর্টে আসে। এরপর সেটা যাচাই করে প্রস্তুত করা হয় পেপারবুক।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও গত দেড় দশক ধরে চাপে থাকা বিএনপি এখন প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট।
ক্ষমতায় পট পরিবর্তনের পর এই মামলা এখন পুনরায় তদন্ত করে নতুন করে বিচার দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন।
তিনি বলেছেন, “ন্যায়বিচারের স্বার্থে এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামিদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।”
প্রকৃত আসামি বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন- সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যারা এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়নি। তারা চেয়েছিল, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে। বিএনপি সরকার যেন ক্ষমতায় না থাকতে পারে।
“এই পরিস্থিতি তৈরি করায় পরবর্তীতে এক-এগারো সরকার আসলো। এঘটনার সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দীন আহমদ জড়িত থাকতে পারেন।”
আওয়ামী লীগ নেতারা ২১ আগস্টের ওই হামলার জন্য বরাবরই বিএনপির দিকে অভিযোগ করে আসছিল। তারা বলছিল, জঙ্গিদের সহায়তায় এই হামলার ছক এঁটেছিলেন তারেক রহমান।
মামলার রায়ে বিচারকও বলেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করতেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।
তবে মাহবুবউদ্দিন খোকনের দাবি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিএনপি নেতাদের এই মামলায় আসামি করা হয়।
তিনি বলেন, “আসামি মুফতি হান্নান প্রথমে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে অন্যদের নাম বলেছে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ মামলায় ৬৬ সাক্ষী হওয়ার পর বিএনপির আমলে বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দকে পুনঃনিয়োগ দেয় সরকার। এ সময় তাকে এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
“এই কর্মকর্তা প্রতিহিংসার বশবর্তী মুফতি হান্নানকে ফের রিমান্ডে নিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করেন। দ্বিতীয়বার জবানবন্দিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হয়েছে।”
শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি সরকার বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। এক মাস ১০ দিনের মধ্যে ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর ওই কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
সেই তদন্তে এই হামলার পেছনে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকার কথা বলা হয়। তবে কোন দেশের সংস্থা, তা বলা হয়নি।
এর মধ্যে ২০০৫ সালের জুন মাসে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরেকে ধরে নিয়ে এসে তাকে হামলাকারী হিসাবে দেখা যায় সিআইডি। তখনই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
পরে আদালতেই প্রমাণিত হয় যে বিএনপি সরকার আমলে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে পুলিশ জজ মিয়াকে নিয়ে ‘নাটক’ সাজিয়েছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় তার নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার জজ মিয়া পরের বছর কারাগার থেকে ছাড়া পান।
মামলার তদন্তে ৪ বছর
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন মতিঝিল থানার এসআই ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে ছিল ডিবি, পরে তার ভার পড়ে সিআইডির ওপর।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের ‘জজ মিয়া নাটক’ পেরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবির।
তাতে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন এবং হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানকে আসামি করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
দুই বছর তদন্তের পর তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ। তাতে আসামির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২।
১৪ বছর পর রায়
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালতের রায়ে ৪৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়। তার মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ।
পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে আদালত।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।
আসামিদের মধ্যে ভিন্ন মামলায় মুফতি হান্নানসহ ৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাবর এখনও কারাগারে।