সুন্দরবনে আগামী তিন মাস ঢুকতে পারবে না বনজীবী ও মৎস্যজীবীরা, যেতে পারবে না পর্যটকরাও। উদ্দেশ্য সুন্দরবনের প্রাণীকূল রক্ষা। কিন্তু প্রশ্ন আসছে, এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত আসলে কতটা বিজ্ঞানসম্মত কিংবা কার্যকর?
একজন গবেষক দেখিয়েছেন, মৎস্য ও প্রাণীকূলের প্রজনন ঋতুর কথা বলে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও সেই হিসাবে রয়েছে গড়মিল।
আর ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষতির পর বনে যেতে না পারলে বনজীবী ও মৎস্যজীবীরা যে জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়বে, তাও বিবেচনায় রাখার সুপারিশ করছেন গবেষকরা।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিষেধাজ্ঞার সময়কালের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে দেখিয়ে নিজেরা পার পেতে চাইছে। আর এই সময়ে বনজীবী ও মৎস্যজীবীদের সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা।
বন বিভাগের ঘোষণা অনুযায়ী, ১ জুন থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে বনজীবী, মৎস্যজীবী ও পর্যটকদের ঢোকা নিষিদ্ধ থাকবে।
সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত দুই মাস সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকত।
২০২২ সালে মৎস্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে করা হয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে। এই অংশে জলভাগের পরিমাণ ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
সুন্দরবনে ২৮৯ প্রজাতির মতো স্থলজ প্রাণী এবং ২১৯ প্রজাতির মতো জলজ প্রাণীর বসবাসের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর।
সুন্দরবনের তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।
নিষেধাজ্ঞার সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন
কোন বিবেচনায় জুন থেকে অগাস্ট পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা, তা খুঁজে পাচ্ছেন না প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সুন্দরবনের প্রাণী রক্ষায় এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় বলে বন বিভাগ জানিয়েছে। কিন্তু বনের ভেতরের যে মাছ ও কাঁকড়া রয়েছে, তারা তো এই সময়ে ডিম দেয় না।
“কাঁকড়া ডিম দেয় বাংলা শ্রাবণের শেষ থেকে ভাদ্রের শুরু পর্যন্ত। কিন্তু এখন তো জ্যৈষ্ঠ মাস, এই সময়ে কাঁকড়া ডিম দেয় না, এমনকি আষাঢ়েও দেয় না। তাহলে এই নিষেধাজ্ঞা কেন?”
সুন্দরবন যাদের আবাসস্থল সেই মাছেদের প্রজনন ঋতুও এই সময় নয় জানিয়ে পার্থ বলেন, “আবার সুন্দরবনের প্রধানতম মাছ দাতিনা, পায়রা, কাইন, এগুলোর প্রজনন সময়ও এখন না। বাঘ, বন্য শূকর, ভোঁদর, এদের প্রজনন ঋতু তো একেকটির একেক সময়, তাও এখন নয়।”
আবার এই সময়ে মৌচাক থেকে মধু আহরণ যদি না হয়, তবে তা মৌমাছির জীবনচক্রেও প্রভাব ফেলবে জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, “বনের পাইন, গেওয়া, গরানের ফুল ফুটছে এখন, চাকে চাকে মধু, এই মধু সংগ্রহ করতে হবে। যদি চাক থেকে মধু সংগ্রহ না করা হয়, তাহলে মৌমাছির মৃত্যু হয়, মৌমাছির পরাগায়ন সীমিত হয়ে যাবে।”
লেখক-গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা সুন্দরবনে ঢোকায় এই সময়ে নিষেধাজ্ঞার বিরোধী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বনজীবীরা বনে যায় বনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। গোলপাতায় যদি মানুষ হাত না দেয়, তাহলে গাছ মরে যাবে।
“সিডরের পরে দুই বছর পর্যন্ত গোলাপাতায় হাত দেওয়া যাবে না, তখন বলেছিল বনবিভাগ। পরে সেটা আন্দোলনের মুখে তুলে নেয়। মৌচাক যদি মানুষ না ভাঙে তাহলে মৌচাকের বিস্তার হবে না, মৌমাছি পরাগায়ন করতে পারবে না, মরে যাবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের খণ্ডকালীন এই শিক্ষক সুন্দরবন নিয়ে সিদ্ধান্ত যারা নেন, তাদের বোঝাপড়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “বনজীবীরা যদি বনে না যায়, তাহলে বন বাঁচবে না- এটা বুঝতে আমাদের ১০০ বছর লাগবে। মানুষের স্পর্শ ছাড়া সুন্দরবন বিকশিত হবে না, এটা আমাদের বুঝতে হবে।
“কিন্তু যারা নিধেধাজ্ঞা দেয়, তারা বন দেখেন ক্যামেরায়, শীতের সময়। সে বন আর আসল সুন্দরবনের পার্থক্য রয়েছে।”
ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে, সেই অবস্থায় সুন্দরবনে বনজীবী ও মৎস্যজীবীদের ঢোকা বন্ধের মতো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন গওহার নঈম।
পাভেল পার্থও বলেন, যাদের জীবন সুন্দরবনকেন্দ্রিক; রেমাল পরবর্তী তাদের জীবন-জীবিকা আরও ঝুঁকিপূর্ণ করবে এই নিষেধাজ্ঞা।
বনজীবী ও মৎস্যজীবী ঢোকা বন্ধ না করে তেল, কয়লা, সিমেন্টসহ রাসায়নিক পরিবহনকারী জাহাজ এই সময় সুন্দরবনে ঢোকা নিষিদ্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঘূর্ণিঝড়ের পরে এখন নোনা পানি বের করার ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে পাভেল বলেন, “পারলে আজই লবণ পানিকে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।”
এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসলে কাজে দেয় কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে গবেষক পাভেল পার্থের।
তিনি বলেন, এই তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আসলে কতটুকু কাজে আসবে কিংবা আদৌ কোনও কাজের কি না, তা নিয়ে গবেষণা দরকার।
“নয়ত ভুল সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার এই ভুল সিদ্ধান্ত ফ্রুটফুল হবে না, বরং ক্ষতি করবে মারাত্মকভাবে।”
নিষেধাজ্ঞা লোক দেখানো?
সুন্দরবন ঘিরে বসবাস এবং জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন, এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নিষেধাজ্ঞায় কাজ শতভাগ হয় না, লোক দেখানো কিছু কাজ হয়।
“নিষেধাজ্ঞাটা কিন্তু গোটা সুন্দরবনে। এ কারণে বনের ভেতরের নদী-খালে সাধারণ জেলেরা যেতে পারেন না। কিন্তু যারা গভীর সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে মাছ ধরেন, তাদের জন্য কিন্তু এ সময়টা সুবর্ণ সুযোগ। কারণ, তখন সাধারণ জেলেরা থাকে না, মানুষ থাকে না। খুব সহজেই তারা ঢুকে যেতে পারে।
সুন্দরবনের অন্তত ৫০ ভাগ জায়গাজুড়ে অভয়ারণ্য। যেখান থেকে কোনও ধরনের মাছ আহরণ করা যায় না বছরের কোনও সময়ই।
নিষেধাজ্ঞা সেখানেও মাছ ধরার অবাধ সুযোগ করে দেয় দাবি করে ওই ব্যক্তি বলেন, “সাধারণ সময়েই ওদের আটকানো যায় না, আর এখন তো নিষেধাজ্ঞা। কেউ নেই আশেপাশে, কেউ দেখবে না।”
এদের সঙ্গে বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
“এরা প্রভাবশালী, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আতাঁত রয়েছে; অভয়ারণ্যের মুখসহ পুরো বনের ভেতরে বিভাগের পুলিশ ফাঁড়ি, স্টেশন, অফিস রয়েছে, ট্রলারে করে টহল দেয়। তাদের দৃষ্টির আড়ালে অভয়ারণ্যে যাওয়া সম্ভব না। অথচ এরা ইজারা নেওয়ার মতো করে অভয়ারণ্য দখল করে নেয়। এই নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য ‘লাকি নিষেধাজ্ঞা’।”
যা বলছেন বন কর্মকর্তারা
নিষেধাজ্ঞা নিয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা বন বিভাগ কর্তৃক আরোপিত নয়, মন্ত্রিপরিষদ থেকে দেওয়া। আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে কেবল তা বাস্তবায়ন করছি।”
এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আপনারা কিছু জানিয়েছিলেন কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি তো মৎস্যজীবী নই। এ জনগোষ্ঠী যদি আবেদন করে, তাহলে সরকার সেটা দেখতে পারে। আমার আর কিছু বলার নেই এ নিয়ে।”
নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করতে তারা কাজ করছেন জানিয়ে মিহির বলেন, টহল পুলিশ টহল দেবে, মাইকিং করা হচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞার সময়ে মৎস্য আহরণসহ অন্য কোনও অনিয়মে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে বন বিভাগ।
সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসীন হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে জানান, নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে অনুমতি ছাড়া কোনও পর্যটক, জেলে বা মধু আহরণকারী বনে ঢুকতে পারবে না।
“বনের ভেতরে ১৬টি স্টেশন রয়েছে আমাদের, তারা পুরো বিষয়টি মনিটর করবে। আমাদের অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না এবং আমরা অনুমতি দেব না।”
ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী এই সময়ে নিষেধাজ্ঞার বিকল্প ভাবা যেত কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের কিছু করার নেই। নির্দেশনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেওয়া।”
তবে ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারের কাছে আবেদন করতে পারেন জানিয়ে আবু নাসের বলেন, “যারা ভুক্তভোগী, তাদেরকে আবেদন করতে হবে। যেমন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন আবেদন করেছে আমাদের কাছে। আমরা উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। উপর থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেটা হবে।”
ঘূর্ণিঝড় রেমালে দেশজুড়ে ১৬ মানুষের প্রাণহানি, ২ লাখ ঘর বিধ্বস্তের পাশাপাশি বনবিভাগের প্রায় ৭ কোটি টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবনে ১২৭টি হরিণ ও ৫টি বুনো শূকরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।