দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠার পর গত ২০ বছরে ছয়টি কমিশন দায়িত্ব পালন করেছে। এর মধ্যে তিনটি কমিশনই বিদায় নিয়েছে তাদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে।
মেয়াদপূর্তির আগেই বিদায় নেওয়া তিনটি কমিশনের চেয়ারম্যানকেই সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করতে দেখা গেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে পদত্যাগ করেন অপর দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও মোছা. আছিয়া খাতুনও।
পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পেলেও দেড় বছর বাকি থাকতেই ‘ব্যক্তিগত’ কারণই দেখিয়ে তারা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ১০ ধারার বিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে শূন্যতা পূরণে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে সর্বোচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল ঘটতে দেখা যায়।
এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও অপর দুই কমিশনারের এক সঙ্গে পদত্যাগের খবর আসে।
২০ বছরে ছয় কমিশন
২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে একই বছরের ২১ নভেম্বর দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান।
আইন হওয়ার তিন বছর পর ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা হয়। দেরিতে বিধি হওয়ায় কারণে প্রথম তিন বছর প্রথম কমিশনের কার্যক্রম ছিল সীমিত।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ‘এক-এগারোর’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করে সুলতান হোসেন খান নেতৃত্বাধীন কমিশন।
এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় কমিশন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের এপ্রিলে হাসান মশহুদ চৌধুরী পদত্যাগ করেন। তখন পদত্যাগের কারণ হিসেবে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, কমিশনের কাজে গতি আনার জন্যই তার পদত্যাগ। তবে তার সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া দুই কমিশনার হাবিবুর রহমান ও মনজুর মান্নান থেকে যান।
এরপর ২০০৯ সালের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব গোলাম রহমান দুদকের তৃতীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। আর হাসান মশহুদ চৌধুরীর কমিশনের দুই কমিশনার হাবিবুর রহমান ও মনজুর মান্নানের মেয়াদ শেষ হলে ২০১১ সালে নতুন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক জেলা জজ মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) এবং দুদকের এক সময়ের মহাপরিচালক মো. বদিউজ্জামান।
এরপর মেয়াদ শেষে গোলাম রহমান চলে গেলে ২০১৩ সালের জুনে চেয়ারম্যান হন বদিউজ্জামান। তিনি প্রথমে কমিশনার এবং পরে চেয়ারম্যান পদে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দুদকের চতুর্থ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
বদিউজ্জামানের মেয়াদ শেষে ২০১৬ সালের মার্চে নিয়োগ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ। পঞ্চম এ কমিশনে তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন সাবেক সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান।
ইকবাল মাহমুদ কমিশনের মেয়াদ শেষে ২০২১ সালের মার্চে ষষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান আরেক সাবেক সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন সাবেক জেলা জজ মো. জহুরুল হক।
এদিকে, ইকবাল মাহমুদের কমিশনের সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের মেয়াদ পূর্ণ হলে গত বছরের জুলাইয়ে সে পদে স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক সচিব মোছা. আছিয়া খাতুন।
যেভাবে নিয়োগ হবে সপ্তম কমিশন
দুর্নীতি দমন কমিশনের ৬ ধারায় কমিশনারদের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৫ বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন তারা।
এ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী কমিশনাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন ও হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব বাছাই কমিটির সদস্য হবেন। তবে তাকে না পাওয়া গেলে বা অসম্মত হলে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্য হবেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি এ কমিটির সভাপতি হবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাছাই কমিটির কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা করবে।
কমিশনার নিয়োগে সুপারিশের উদ্দেশ্য বাছাই কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে তিন জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের প্রতিটি শূন্য পদের জন্য দুই জন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে।