Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

মাদাগাস্কারের কারাগারে তাদের ৬ বছর

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরীর সঙ্গে মুক্ত হওয়া চার নাবিক।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরীর সঙ্গে মুক্ত হওয়া চার নাবিক।
[publishpress_authors_box]

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ রাষ্ট্র মাদাগাস্কারে বন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়ে ছয় বছর পর দেশে ফিরলেন বাংলাদেশি চার নাবিক।

২০১৮ সালে ‘এমভি ফ্লাইং’য়ে সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় জলসীমায় অনুপ্রবেশের অপরাধে সে দেশের কোস্টগার্ড জাহাজটির ১৭ নাবিককে আটক করে।

তাদের মধ্যে চার বাংলাদেশি হলেন- বাগেরহাটের হাসিব সরদার ও মোহাম্মদ এমরান এবং নারায়ণগঞ্জের সোহেল রানা ও এইচ এম রোমান। বাকি নাবিকরা চীন ও মিয়ানমারের নাবিক।

আদালতে বিচারে তাদের তখন ৫ বছর কারাদণ্ড হয়েছিল; গুনতে হয়েছিল বড় অঙ্কের জরিমানাও। পরে আরেকটি মামলায় তাদের সাজা দেওয়া হয় ২০ বছর। এরপর মাদাগাস্কারের একটি কারাগারে বন্দি ছিলেন এই নাবিকরা।

নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশি নাবিকরা গত ৩১ জুলাই দেশে ফেরেন।

শুক্রবার বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে এই নাবিকরা এসেছিলেন; তারা তাদের দুর্বিষহ জেল জীবনের বিবরণ তুলে ধরেন।

তারা অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশি এক প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সি ব্রাদার্স শিপিং এন্টারপ্রাইজের খপ্পরে পড়ে তারা এই দুর্বিসহ অবস্থায় পড়েন।

এজন্য তারা সেই ব্রাদার্স শিপিং এন্টারপ্রাইজের মালিক মীর হানিফের শাস্তি চান এবং তাদের জীবন এবং পরিবারের জীবন নষ্ট করে দেওয়ারও ক্ষতিপূরণ চান।

আটক হয় যেভাবে

পানামার পতাকাবাহী ‘এমভি ফ্লাইং’ জাহাজটি চীনের একটি কোম্পানি ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করছিল। ২০১৯ সালে খালি জাহাজটি মাদাগাস্কার পৌঁছে নভেম্বর মাসে। প্রথমবার তাদের সীমানায় প্রবেশ করতে গেলে তাড়া খায় কোস্টগার্ডের।

মুক্ত নাবিকরা জানান, সেই দফায় রক্ষা পেলে আরেকবার প্রবেশের জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। একমাস সাগরে থাকার পর ডিসেম্বর যখনই আবার ঢুকতে যায় তখন আবার মাদাগাস্কার কোস্টগার্ডের নজরে পড়ে। ক্যাপ্টেন জাহাজের চলা বন্ধ না করায় কোস্টগার্ড গুলি করে জাহাজ লক্ষ করে।

রোমান বলেন, “কোস্টগার্ড অনেক গুলি করার পর শেষ মুহূর্তে জাহাজে আসলো। আমরা সবাই হাত উপরে তুললাম এবং সবাই ক্যাপ্টেনের ওপর অনেক রেগে ছিলাম,  কেন তিনি জাহাজ চালানো বন্ধ করল না? আর্মি জাহাজে উঠে আমাদের সকলের ডলার, চায়না মানি, ল্যাপটপ এমনকি জুতা পর্যন্ত নিয়ে যায়।  আমাদের একেকজনের জনের কাছে বেতন হিসেবে প্রায় ৫-৬ হাজার ডলার এবং  ৭ -৮ হাজার ইউয়ান ছিল।”

কোস্টগার্ডের গুলিতে দুই চীনা নাবিক আহত হয়েছিলেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর চিকিৎসার জন্য সেই দুই নাবিককে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় চীন। বাকি ১৫ জন (চীনের ৯ জন, বাংলাদেশি ৪ জন এবং মিয়ানমারের ২ জন) আটকা পড়েন।

মাদাগাস্কার কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, জাহাজটি অবৈধভাবে গোলাপ কাঠ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মাদাগাস্কারের জলসীমায় ঢুকেছিল। অনুপ্রবেশের দায়ে ১৩ জনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং মাদাগাস্কার মুদ্রায় ১ কোটি জরিমানা করা হয়। ২০১৯ সাল থেকে ১৫ নাবিক জেলে সেই দণ্ড ভোগ শুরু করেন।

এরপর মাদাগাস্কারের বিশেষ আদালতে গোলাপ কাঠ চুরি করে পাচারের অভিযোগে জাহাজের ১৩ নাবিকের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। সেই মামলায় ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ, চীন এবং মিয়ানমারের ১৩ নাগরিকদের দোষি সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং মাদাগাস্কার মুদ্রায় ১০০ মিলিয়ন অর্থ জরিমানা করে।

মানচিত্রে মাদাগাস্কারের অবস্থান।

একেকটি রাত ‘এক মাসের মতো’

কারাগারে দুর্বিষহ জীবনের বর্ণনা দিয়ে নাবিক সোহেল রানা বলেন, “এত ছোট্ট স্থান ছিল যে দুই পা মেলে ঘুমাতে পারতাম না। একদিকে কাত হলে অন্য দিকে কাত হতে পারতাম না। মশার কামড় কত খেয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না।”

খাওয়ার কষ্টেও ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতি মাসে একবার ভাত দিত, কোনও কোনও মাসে ২ বার দিত। আর অন্যান্য দিন সকালে ও বিকালে মিষ্টি আলুর মতো একটা খাবার। দুই বেলা কারাগারের সবাইকে এই খাবার দিত। কষ্ট কাকে বলে তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।”

হাসিব সরদার বলেন, “অসহায় অবস্থায় মনে হয়েছিল যে আর কিছুদিন পরে হয়ত এখানেই মারা যাব। আবার এটাও চিন্তা করতাম, এখানে মারা গেলে, আমার পরিবার কি আমার লাশটা দেখতে পাবে।

“আর ব্রাদার্স শিপিংয়ের মালিক হানিফের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হয়েছিল, হানিফকে কাছে পেলে মেরে ফেলতাম।”

ইঞ্জিনিয়ার সনদ নিয়ে কাজ করেছেন জাহাজের বয়লারে

বাংলাদেশ থেকে নাবিকরা যখন জাহাজে চাকরির জন্য যান তাদের মেরিন একাডেমি, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

কিন্তু এেই চার নাবিকের সবাই ভুয়া সনদ নিয়েই জাহাজে যোগ দিয়েছিলেন। এজন্য তারা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স শিপিং এন্টারপ্রাইজের শরণাপন্ন হন। জাহাজে নাবিক সরবরাহের নামে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে বিদেশে লোক পাঠায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার পরও ব্রাদার্স শিপিং এন্টারপ্রাইজ প্রতারণার মাধ্যমে সোহেল রানাকে জাহাজের ক্যাপ্টেন, হাসিব সরদারকে চিফ অফিসার, এইচ এম রোমানকে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং মোহাম্মাদ এমরানকে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ভুয়া সনদ ও সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) তৈরি করে জাহাজে পাঠায় ।

নাবিকরা অভিযোগ করেছেন, যতদিন ইচ্ছা ততদিন জাহাজে চাকরি করতে পারার চুক্তিতে সোহেল রানার কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, হাসিব সরদারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা, রোমানের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা এবং এমরানের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল ব্রাদার্স শিপিং। নাবিকদের বেতন থেকে অলিখিতভাবে প্রতিমাসে জনপ্রতি ২০০ ডলার করে কেটে নিত।

এমরান বলেন, “২০১৮ সাল থেকে ৯ মাস আমরা চাকরি করি এবং বেতন ঠিকমতো পাচ্ছিলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন জাহাজটি ভিয়েতনামের দানাং পোর্ট থেকে মাদাগাস্কারের উদ্দেশে রওনা হয়। খালি জাহাজটি সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য আমাদের জানা ছিল না। পরে যখন জানতে পারি তখন ধরা পড়ে যাই।”

নাবিকদের অভিযোগ নিয়ে জানতে ব্রাদার্স শিপিংএজেন্সির মালিক মীর হানিফ এবং তার ছেলে মীর সুমনকে ফোন দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়। জানা গেছে, তারা পালিয়েছেন।

ছয় বছর ভিনদেশে কারাগারে থাকাকালীন নাবিকদের বাংলাদেশি পরিবার খুবই অসহায় জীবন পার করছিল। কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা।

এসময় তাদের আর্থিক এবং আইনি সহায়তা দিয়ে এগিয়ে আসে মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। পুরো ছয় বছর তারা পরিবারকে অন্তত ছয় লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়ে যায়।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরীর সঙ্গে মুক্ত হওয়া চার নাবিক।

যেভাবে মুক্তি পেলেন নাবিকরা

বাংলাদেশি নাবিকদের সাজাভোগের খবরটি জেনে তৎপর হয় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। তখন চীন ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ ছিল না।

মাদাগাস্কারের আদালতে আসামিদের আইনি সুবিধা না রেখেই নাবিকদের সাজা দেওয়ার বিরুদ্ধে মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দ্বারস্ত হয়।

এরপর ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (আইটিএফ) মাধ্যমে আইনজীবী নিয়োগ করে ২০২০ সালেই সেই আদালতে রিট মামলা করা হয়। দীর্ঘ শুনানির পর প্রথম আবেদন খারিজ হয়ে গেলে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও চাপ প্রয়োগ করা হয় মাদাগাস্কার সরকারকে।

মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নাবিক-শ্রমিকদের যত সংগঠন ছিল, সবার মাধ্যমে মাদাগাস্কার সরকারকে চাপ দেওয়া হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাইতে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা মাফ করে দেয়। ৩০ জুলাই ছাড়া পেয়ে ৩১ জুলাই অন্য নাবিকসহ বাংলাদেশিরা নিজ দেশে ফেরে।

“অন্তত ২০টি সংগঠনের আইনি প্রচেষ্টা এবং আর্থিক সহযোগিতায় আমরা শেষ পর্যন্ত তাদের নিরাপদে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হই। বলতে গেলে এটা বিশাল এক কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া, যা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু আমরা লেগে ছিলাম বলে সফলতা পেয়েছি।”

তিনি বলেন, “দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় আমরা এতদিন বিষয়টি জানাইনি। শুক্রবার তাদেরকে আমাদের অফিসে ডাকি এবং তাদের দুর্বিসহ অবস্থার করুণ কাহিনী শুনি। অনেকটা বাংলাদেশের আয়না ঘরের মতোই নাবিকদেরকে মাদাগাস্কের জেলখানায় থাকতে হয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত