অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ দিন হয়ে গেছে। খেলা নেই ক্রীড়াঙ্গনে। তবে ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের নানান দাবি ও প্রতিবাদে প্রতিদিন মুখরিত এই অঙ্গনের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো যেন চলৎ শক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা ভয়ে কাতর। কেউ রাজনৈতিক পালাবদলে ভীত হয়ে ফেডারেশনমুখো হচ্ছেন না। অনেকে আত্মগোপনে। কেউ দেশছাড়া, কেউ-বা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই অবস্থায় পুরো ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
সকাল সন্ধ্যার অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে থাকা দেশের ৫০টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ৩৩ জন সভাপতি লাপাত্তা। বাকি যে ১৭ জন সভাপতি আছেন এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বছরে দুয়েকবার মন চাইলে ফেডারেশনে আসেন!
খোঁজ নেই এসব ফেডারেশনের ৩৬ জন সাধারণ সম্পাদকের। এদের বেশিরভাগই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই রাজনৈতিক পালাবদলের আঁচ টের পেয়ে তারা চলে গেছেন আত্মগোপনে।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আত্মগোপনে আছেন ৫ আগস্ট থেকে। ইতিমধ্যে তিনি পদত্যাগের সম্মতি দিয়েছেন। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও ৫ আগস্টের পর মতিঝিলের বাফুফে ভবনে আসেন না। যদিও তিনি বাসা থেকেই দাপ্তরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও।
অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের পদটি ঠিকই ধরে রেখেছেন। কিন্তু কোনও খোঁজ-খবর নেই।
ওদিকে এই ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব মন্টু প্যারিস অলিম্পিক শেষ করে দেশেই ফেরেননি। চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার অনুপস্থিতিতে কাজ চালাচ্ছেন যুগ্ম সম্পাদক এসএম শরাফত হোসেন। এই কর্মকর্তা গত কয়েক দিন ফেডারেশনে এসে মিটিং করেছেন।
ক্যাম্প চালানোর জন্য যে অর্থ দিয়ে গেছেন মন্টু সেটা সর্বোচ্চ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। বর্তমানে ক্যাম্পে অনুশীলন করছেন ২৩ অ্যাথলেট। কিন্তু কোষাধক্ষ্য জামাল হোসেন টাকা তুলতে পারছে না। নিয়ম অনুসারে ফেডারেশনের চেক বইয়ের পাতায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যে কোনও একজনের সই থাকতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তারা কোনও টাকাও তুলতে পারছেন না। স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় ফেডারেশন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অ্যাথেলেটিকস ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “বর্তমানে যা অবস্থা তাতে টাকা না তুলতে পারলে ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে।” আগামী সেপ্টেম্বরে চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে জুনিয়র সাফ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপ। এই প্রতিযোগিতায় বিকেএসপির ১৬ জন ও নৌবাহিনীর ১ জন অ্যাথলেটকে বাছাই করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে অংশ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
সাইক্লিং ফেডারেশনের সভাপতি কবির বিন আনোয়ার সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব। এমনিতেই তিনি ফেডারেশনে খুব কম আসেন। সরকার পতনের পর তো তাকে দেখাই যায়নি ফেডারেশন কার্যালয়ে। সাধারণ সম্পাদক তাহের উল আলম স্বপনও ফেডারেশনে অনুপস্থিত। দাবা ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ফেডারেশন কর্মকর্তারা। পাহাড়সম দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে বেনজীর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কাবাডির সভাপতি পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার চুক্তিও বাতিল করেছে। কাবাডির সাধারণ সম্পাদক ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। এরই মধ্যে দুজনের নামেই হয়েছে হত্যা মামলা। স্বাভাবিকভাবে কাবাডি ফেডারেশনও বিপাকে। স্বাভাবিকভাবেই এ দুজন অনুপস্থিত রয়েছেন।
শুটিং ফেডারেশনও চলছে মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুকে ছাড়াই। তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন বলে গুঞ্জন। হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাসিনো কাণ্ডে অভিযুক্ত মমিনুল হক সাঈদ নেপালে পালিয়ে গেছেন সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই। জার্মানিতে উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলতে চলতি মাসেই যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ হকি দলের । সেই সফর এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে।
সাঁতার দলের সঙ্গী হয়ে প্যারিস অলিম্পিকে যান সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা বদরুল সাইফ। যিনি দীর্ঘদিন ধরে গোপালগঞ্জ জেলা যুব লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সভাপতিও তিনি। মোল্লা সাইফ এই অস্থির সময়ে দেশে ফিরবেন না বলেই খবর পাওয়া গেছে।
বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুহিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সরকার পতনের পর ফেডারেশনমুখী হননি এই কর্মকর্তা। আগামী ২১ আগস্ট থেকে দুবাইয়ে শুরু হবে এশিয়ান জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা বিকেএসপির ৩ বক্সারের। কিন্তু আদৌ তারা সেখানে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন বিকেএসপির কোচ লিটন মিয়া, “আমরা তুহিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রতিযোগিতায় না গেলে আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশন থেকে নেগেটিভ পয়েন্ট দেওয়া হবে বাংলাদেশকে। এর ফলে পরবর্তীতে কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কঠিন হতে পারে আমাদের।”
বাস্কেটবল ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও আত্মগোপনে। আর ক্যারম ফেডারেশনের সভাপতি ও সাবেক ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে।
ব্যাডমিন্টনের সভাপতি তথ্য কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মালেক সরকার পতনের পর থেকে ফেডারেশনে আসেন না। চলতি মাসেই হওয়ার কথা শেখ রাসেল স্কুল ব্যাডমিন্টন ও জাতীয় জুনিয়র ব্যাডমিন্টন। এছাড়া ইয়োনেক্স আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে মালয়েশিয়ায় অংশ নেওয়ার কথা বাংলাদেশের। এগুলোর ব্যাপারে তাই কেউ কোনও সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন না।
এদিকে টেবিল টেনিসের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ও সহ-সভাপতি খন্দকার হাসান মুনীর সুমনও সরকার পতনের পর থেকে নিখোঁজ। টেনিসের সভাপতি সাবেক নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও অনুপস্থিত আছেন ফেডারেশনে।
দেশের ভলিবল অঙ্গনের সমার্থক শব্দ হয়ে গেছেন আশিকুর রহমান মিকু। কয়েক দফা মিলিয়ে প্রায় ২৫ বছর বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার আঁকড়ে বসে আছেন এই ক্রীড়া সংগঠক। ফেডারেশনে অবশ্য তিনি ইদানিং নিয়মিতই আসছেন। যদিও আশিকুর রহমানের মুখে অবাক করা কথা, “এমন না যে পদ পদবী চিরদিন ধরে রাখতে হবে। ছেড়ে দিবো।” তিনি জানালেন, ফোনে যোগাযোগ করতে পারছেন না ভলিবলের সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়ের আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাই ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান সেন্ট্রাল ভলিবলের ভবিষ্যতও অন্ধকার হয়ে পড়েছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তথ্য অনুযায়ী দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থা ৫৫টি। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ছাড়া বাকি সবগুলোর সভাপতি সরকার মনোনীত।
দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোয় এক সময় একের পর এক নির্বাচন হতো। কিন্তু সেগুলো হতো নামেমাত্র। সেগুলোতে সেই অর্থে ভোট হতো না। এভাবেই কোনও কোনও ফেডারেশনে গঠিত হতো ‘পকেট কমিটি।’
এর সঙ্গে যোগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা। এতেই খেলাধুলার অঙ্গনে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। যার প্রভাব পড়ছে প্রতিটি খেলায়। সাধারণ খেলোয়াড়দের দাবি, এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ক্রীড়াঙ্গনে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। যে সংস্কারের দাবিতে প্রতিদিনই কোনও না কোনও ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়েরা আন্দোলন ও মানববন্ধন করে চলেছেন।
ফেডারেশনগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন এবং কোন কোন সভাপতি অনুপস্থিত এটা জানতে চেয়ে এনএসসিকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটি চিঠি দিয়েছে। সেই অনুসারে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ১৪ আগস্ট ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) এস এম শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম। এনএসসির তথ্য অনুসারে ২৯ জন সভাপতি উপস্থিত আছেন। যদিও তাদের সেই চিঠির মন্তব্যের ঘরে এনএসসির পক্ষ থেকে কাবাডি ফেডারেশনের প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, নতুন সভাপতির দায়িত্ব প্রদানের জন্য পরিষদ বরাবর পত্র দেওয়া হয়েছে। প্যারা অলিম্পিক কমিটির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সভাপতি অসুস্থ থাকায় সহ-সভাপতি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে, সভাপতি উপস্থিত সেই তথ্য ক্রীড়া পরিষদের কাছে নেই।
এস এম শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম বলেন , “কোন ফেডারেশনের সভাপতি কী অবস্থায় আছেন, অনুপস্থিত কিনা এসব জরুরি ভিত্তিতে জানাতে চিঠি দিয়েছিলাম ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে। আমরা তথ্যগুলো জেনে তা প্রতিবেদন আকারে দাখিল করেছি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে। বেশ কিছু ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নেই।”
এনএসসির হিসাব ধরলে ২১ জন সভাপতি বর্তমানে লাপাত্তা। তবে সকাল সন্ধ্যার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ ছবিটা। যেখানে ৫০টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে ৩৩ সভাপতিই উধাও।