রাজনৈতিক পালাবদলের পর দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে তৈরি হয় অস্থিরতা, দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। তাতে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতে অন্তত ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি(বিজিএমইএ) শনিবার ঢাকার উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানায়। এসময় সঙ্কট কাটাতে বেশ কিছু দাবিও তুলে ধরে তারা।
দেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় খাত পোশাকি শিল্প। তাই এই খাতের ক্ষতি প্রভাব ফেলেছে দেশের মোট রপ্তানি আয়েও।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এর মধ্যে ৯২৯ কোটি (৯ দশমিক ২৯ বিলিয়ন) ডলার এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, এর আগে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে ওভেন পোশাক থেকে এসেছিল ১৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। আর নিট পোশাক থেকে এসেছিল ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “শ্রমিক অসন্তোষের ফলে ৪০ কোটি ডলারের পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানতে পারছি। এটি আরও বাড়বে।”
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউয়ে জুলাইয়ে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল পোশাক কারখানা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই গাজীপুর; ঢাকার সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পোশাক শ্রমিকরা নানা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। তাতেই এসব ক্ষতির মুখে পড়ে এই খাত।
যদিও সেসব পরিস্থিতি পেরিয়ে পোশাক খাত বর্তমানে ‘স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে’ মন্তব্য করে রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বেশ কিছু কার্যাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে গেছে।
বর্তমানে এ খাতে স্থিতিশীলতা ‘পুনরুদ্ধার হওয়ায়’ আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো আবার ফিরে আসছে বলে দাবি করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, “পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী গঠন করা হয়েছে এবং এই বাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিতভাবে টহল দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু করেছে বিজিএমইএ।
“পোশাক কারখানাগুলোয় আগস্টের বেতন পরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দেয় বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগস্টের বেতনভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।”
শ্রম অসন্তোষের কারণে আশুলিয়ায় ৩৯টি পোশাক কারখানায় সেপ্টেম্বরের বেতনভাতা পরিশোধের সক্ষমতা ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সব কারখানা যাতে বিপদে না পড়ে, সেজন্য তাদেরকে সুদহীন সহজ শর্তের ঋণ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিন মাস কোনও কারখানায় যেন গ্যাস-বিদ্যুতের লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করার ও ব্যাংক সুদের হার একক অংকে নামিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পোশাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিক যেন ন্যায্য মূল্যে পণ্য পান, সেজন্য তাদেরকে টিসিবির কর্মসূচিতে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান রফিকুল ইসলাম।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখা পোশাক শিল্পের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
সঙ্কট নিরসনে বিজিএমইএর দাবি
পোশাক রপ্তানীতে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজেদের সক্ষমতা ধরে রাখতে সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছে বিজিএমইএ। সেগুলো হলো :
শিল্পে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কাস্টমস বন্দর সংক্রান্ত প্রক্রিয়া আরও সহজ ও দ্রুত করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে লোডিং ও আনলোডিংয়ে অহেতুক সময়ক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে। আগামী ৩ মাস কারখানার ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ব্যাংকখাত সংস্কারের নেতিবাচক প্রভাব যেন উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে না পড়ে।
কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে যেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিল্পকে ব্যবসাবান্ধব করতে যথাযথ নীতি সহায়তা প্রনয়ণের বিষয়ে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে।
শিল্পে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা ও বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণসহ একটি টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ঋণ শ্রেণিকরণ না করা এবং পুনঃতফসিলকরণের সুযোগ দিতে হবে।
তৈরি পোশাক কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের নির্দেশনা দিতে হবে। ঝুটসহ অন্যান্য রিসাইকেলিং উপযোগী বর্জ্য অপসারণ বাইরের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। পোশাক খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রণোদনা পুনর্বহালের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নিরাপদ এক্সিট পলিসির ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।