মণিপুরের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কইরেং সিংয়ের বাড়িতে রকেট হামলার একদিন পরই শনিবার রাজ্যের জিরিবাম জেলায় ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এ সহিংসতা এ বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে জাতিগত সংঘাত আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে থেমে থেমে চলা জাতিগত সংঘাতে বিপর্যস্ত মণিপুরের জিরিবাম জেলার নুংচেপি গ্রামে শনিবার ভোর ৪টার দিকে হামলায় কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়।
তাদের মধ্যে আছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের ৬৩ বছর বয়সী ইউরেমবাম কুলেন্দ্র সিংহ। তিনি ঘুমের মধ্যেই প্রাণ হারান। হামলার জন্য কুকি বিদ্রোহীদের দায়ী করা হচ্ছে।
নুংচেপি গ্রামে হামলার পর সেখান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে রসিদপুর গ্রামে হামলা করে ‘কুকি বিদ্রোহীরা’। সেখানে তাদের সঙ্গে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হয়।
এই দুই গ্রামেই মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষের বাস।
জিরিবামে কুকিদের হামলার বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কে জয়ন্ত বলেন, “শনিবার ভোরে নুংচেপি গ্রামে সন্দেহভাজন কুকি বিদ্রোহীদের হামলায় ইউরেমবাম কুলেন্দ্র সিং নিহত হয়। এরপর সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা গুলি চালাতে চালাতে পার্শ্ববর্তী রসিদপুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়।
“রসিদপুরের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছোড়ে। দুপক্ষের গোলাগুলিতে একপর্যায়ে ৪১ বছর বয়সী বসপতিমায়ুম লখি কুমার নিহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের দিকেও দুর্বৃত্তরা গুলি চালায়। পুলিশ তখন পাল্টা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।”
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কে জয়ন্ত জানান, ঘটনাস্থল তল্লাশি করে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, মরদেহগুলো বিদ্রোহীদের। তারা যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত ছিল। পুলিশ পরে ঘটনাস্থল থেকে আরও একটি মরদেহ উদ্ধার করে।
“জিরিবাম জেলার পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত, তবে নিয়ন্ত্রণে আছে। সেখানে আমরা অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছি,” যোগ করেন পুলিশ কর্মকর্তা কে জয়ন্ত।
শান্ত ছিল জিরিবাম
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে জিরিবামের দূরত্ব প্রায় ২২০ কিলোমিটার। কাছেই আসাম সীমান্ত। এই জেলায় মেইতেই, কুকি, বাঙালি, নেপালি, নাগাসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে।
গত বছর সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও কুকিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মণিপুরের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ বাধলেও এর প্রভাব জিরিবামে পড়েনি। মোটামুটি শান্তই ছিল এখানকার পরিস্থিতি।
তবে এ বছরের জুনে জাতিগত সংঘাতে জিরিবামে এস শরৎকুমার সিং নামে ৫৯ বছর বয়সী এক বাসিন্দার মৃত্যু হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মেইতেই ও কুকি উভয় সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে সে সময় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই জিরিবাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যে মেইতেই ও কুকিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বোঝা যায় হামলায় ড্রোন ও রকেটের ব্যবহার দেখে। শুক্রবার রাজ্যের প্রথম ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কইরেং সিংয়ের বাড়িসহ আরেক জায়গায় রকেট হামলা চালিয়েছিল বিদ্রোহীরা। এতে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়।
সহিংসতার সূত্রপাত
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, গত বছর মণিপুর রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ইম্ফল উপত্যকার চারদিকে পাহাড়ি এলাকায় বাস করা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী জো, নাগা ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে অন্তত ২৩০ জন প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫০ হাজার মানুষ।
নাগা ও কুকিদের দাবি, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে।
মণিপুরের পূর্ব ও দক্ষিণে মিয়ানমার সীমান্ত। রাজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ইম্ফল উপত্যকা মণিপুরের প্রায় ১০ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত। মূলত মেইতেইরা এই ১০ শতাংশ ভূমিতে বাস করে। তাদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। রাজ্যের বিধানসভায় মেইতেইদের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি।
অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে বাস করে কুকি ও উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা।
খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী কুকি ও নাগারা মণিপুরের ৩৫ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। এই পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ।
মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের অনুমতি মেইতেইদের নেই। অন্যদিকে কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ নেই।