গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের এক ভিডিও এসেছে সংবাদমাধ্যমে, যেখানে চলমান আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা রয়েছে।
তবে বাইরে থাকা সমন্বয়করা এই ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে নতুন কর্মসূচি দিয়েছেন তারা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অবরোধে সংঘাত সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর এই প্ল্যাটফর্মের ছয়জন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে গত শুক্রবার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি। শনি ও রবিবার সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও তুলে নেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়া হয় আরেক সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকেও।
তারা সবাই মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে রয়েছেন। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘নিরাপত্তা স্বার্থে’ তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
এরপর রবিবার রাতে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদের এক ফেইসবুক পোস্টে তার সঙ্গে বসে ছয়জন সমন্বয়কের খাওয়ার কিছু ছবি দেওয়া হয়। তার ক্যাপশনে লেখা হয়- “কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ওদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সাথে কথা বললাম। কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে! ওদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি ডিএমপি বদ্ধপরিকর।”
এরমধ্যেই রাত ৯টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা ভিডিও বার্তাটি আসে, যেখানে নাহিদ বক্তব্য পড়ছিলেন; তার সঙ্গে ছিলেন সারজিশ, আসিফ, বাকের, হাসনাত ও নুসরাত। আরিফ সোহেল সেখানে ছিলেন না।
নাহিদ পড়েন- “আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। এটি সরকার ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।”
বার্তা নিয়ে প্রশ্ন অন্য সমন্বয়কদের
ডিবি হেফাজতে থাকা নাহিদের ভিডিও বার্তাটির পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ ফেইসবুকে লেখেন, “অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিবৃতি আদায় ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।”
আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদ জানান, এরকম ঘটনা ঘটতে পারে, এমনটা আগে থেকেই তারা আঁচ করতে পেরেছিলেন।
ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, “সিনিয়ররা আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল– সমন্বয়কদের মাঝে এক গ্রুপকে তুলে নিয়ে গেলে বাকিরা নেতৃত্ব দেবে। কাউকে যদি আটক করে জোরপূর্বক কোনও বিবৃতি আদায় করা হয়, তবে আমরা সেটা না মেনে যারা মাঠে থাকব, তারা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
এর আগে নাহিদ ও আসিফকে পুলিশ পরিচয়ে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল বলে তারা অভিযোগ তুলেছিলেন। ছাড়া পেয়ে তারা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
রিফাত লিখেছেন, “গণস্বাস্থ্য থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই এবং বাকের ভাই তিনজনই স্পষ্ট করে বলেছিল, ‘আমরা যদি না-ও থাকি আন্দোলন চালাইয়া নিবা, আন্দোলন যাতে থেমে না থাকে। আমাদের উপর অনেক ঝড়-ঝাপটা যাবে, যারা বাইরে থাকবে তারাই অন-কমান্ডে থাকবে’।
“তাই সিনিয়রদের শেষ কথাগুলোকে বুকে ধারণ করেই আমরা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। জোরপূর্বক আদায় করা বিবৃতি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করছে।”
এই ভিডিও বার্তার বক্তব্য নিয়ে নাহিদসহ হেফাজতে থাকা কোনও সমন্বয়কের বক্তব্য পাওয়ার সুযোগ সাংবাদিকরা পায়নি।
তাদেরকে ধরে নেওয়ার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারাও দেখা করতে পারেননি।
এই ভিডিও কে করল, কীভাবে দেওয়া হলো- সে বিষয়ে পুলিশের কোনও ভাষ্যও মেলেনি।
নতুন কর্মসূচি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাইরে থাকা সমন্বয়করা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
নাহিদদের ভিডিওটি আসার পর রাত ১২টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সোমবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।
রবিবার রাতে ফেইসবুকে মাসুদ লিখেছেন, “ডিবি কার্যালয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিনিয়র সমন্বয়কবৃন্দদের থেকে জোরপূর্বক বিবৃতি আদায়, সারাদেশে সংগঠিত বিনাবিচারে হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যামামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আগামীকাল (সোমবার) সারাদেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচি সফল করুন।”
যে দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটার হার ৫৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, এখন আর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই।
এই আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার পর কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। কারফিউ দিনে শিথিল থাকলেও রাতে চলছে। ইন্টারনেট পুনরায় চালু হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধই রয়েছে।
আন্দোলনের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগে যারা জড়িত ছিল, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশি অভিযানে গণগ্রেপ্তার চলছে।