Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৬৪ খোপে জীবনের বাজি খেলা জাদুকর

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান: যিনি দাবার বোর্ডে রেখেছিলেন জীবনের সবটুকু বাজি। ছবি: সংগৃহীত।
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান: যিনি দাবার বোর্ডে রেখেছিলেন জীবনের সবটুকু বাজি। ছবি: সংগৃহীত।
Picture of বদিউজ্জামান মিলন

বদিউজ্জামান মিলন

গ্র্যান্ডমাস্টার নিহাল সারিন ১৫ বছর বয়সে কোটি টাকার স্পনসর পেয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন ভারতে। এটা ২০১৯ সালের ঘটনা। নিহাল বেঙ্গালুরুতে অক্ষয়কল্প নামের একটি দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য তৈরির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী স্পনসরের চুক্তি করেন প্রায় ১ কোটি ভারতীয় রুপিতে।

বাংলাদেশের কোনও গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে এমন চুক্তি কখনও কোনও দেশি প্রতিষ্ঠান করেনি। এমনকি কোনও দাবাড়ুর সঙ্গে বড় মাপের কোনও প্রতিষ্ঠানের স্পনসরশিপ নেই। দাবা খেলাকে কেউ পেশা হিসেবে তাই নিতে পারে না। কিন্তু দেশের একমাত্র ব্যতিক্রম দাবাড়ু সদ্য প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। যার উপার্জনের পথ ছিল দাবা। শুধু দাবা খেলে ও কোচিং করিয়ে সংসার চলতো জিয়ার। এই দাবা থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই তিনি ঢাকা শহরে কিনেছেন ফ্ল্যাট।    

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুশোক লেগে আছে স্ত্রী তাসনিম আহমেদ লাবণ্যর চোখে মুখে। পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে তাহসিন তাজওয়ার। ছবি: সকাল সন্ধ্যা।

জিয়া দাবার কোচিং করাতেন অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ভারতসহ নানা দেশে। কিছু দিন আগে জিয়ার সঙ্গে আয়ারল্যান্ড থেকে যোগাযোগ করেন ইউটিউবার খালিদ ফারহান। বাংলাদেশের নতুন দাবাড়ুদের নিয়ে খালিদ ফারহান ইউটিউবে দাবার কোর্স ও সরাসরি কোচিং করানোর জন্য জিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেন ৫ লাখ টাকায়। ২০ জুলাই থেকে জিয়ার সেই কোচিং কোর্স শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই মারা গেলেন জিয়া।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার সঙ্গে তার স্ত্রী তাসনিম আহমেদ লাবণ্যর পরিচয়টা বেশ অদ্ভূত। নব্বইয়ের দশকে তখন দেশে মুঠোফোন আসেনি। ল্যান্ডফোনের ওপর ভরসা। সেই ল্যান্ডফোনের ক্রস কানেকশানে জিয়ার সঙ্গে পরিচয় লাবণ্যর। পরিচয় থেকে বিয়ে।

দাবার বোর্ডে গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে চালে মগ্ন জিয়াউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত।

জিয়া পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ বিজ্ঞান বিভাগে। লাবণ্য ইংরেজি সাহিত্যে। দুজনেই মেধাবী ছিলেন। লাবণ্য ২০০২ সালের ২২তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৪তম হয়েছিলেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান ফেনীতে। কিন্তু সরকারি চাকরির আরাম আয়েশ ও নির্ভাবনার জীবন ছেড়ে লাবণ্য আঁকড়ে রইলেন জিয়াকে।

স্পষ্ট করে বললে সেই অর্থে জিয়ার কোনও উপার্জন ছিল না দাবা ছাড়া। অথচ সংসারটা চালাতেন মসৃণভাবেই। এসব নিয়ে কখনও জিয়ার কাছে আফসোস করেননি লাবণ্য। জিয়ার মৃত্যুর পর বুধবার দাবা ফেডারেশনে এসেছিলেন।

একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ারকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ রাউন্ডে খেলতে পাঠিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ফেডারেশনের অন্য কক্ষে। সেখানে বসেই জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করছিলেন লাবণ্য। জিয়ার আয়ের প্রসঙ্গটি তুলতেই বললেন, “ এসব নিয়ে আমার কোনও আফসোস নেই। জিয়া আমাকে কষ্ট দেয়নি। ও বলতো আমার যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে তোমার চাকরির দরকার নেই।”

অকালেই চলে যাওয়া গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত।

মূলত জিয়ার খেলার বাইরের অন্য আনুষঙ্গিক সব কাজ ম্যানেজারের মতো পালন করতেন লাবণ্য। তিনিই চাইতেন না জিয়া চাকরি করুক। চাইতেন না তার পুরো মনোযোগ সরে যাক দাবা থেকে, “ জিয়া কাদের সঙ্গে খেলবে, কাদের কোচিং করাবে, ওদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা। কত টাকার বিনিময়ে সে কোচিং করাবে- সব যোগাযোগ আমিই করতাম। আসলে আমি ওকে কখনও চাকরির কথা বলিনি। আমি জিয়াকে ২৬৫০ রেটিংয়ের ওপর দেখতে চাইতাম।”

একেবারে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত লাবণ্য বলে যান, “আমার সংসার কীভাবে কীভাবে যেন আপনা আপনি চলে গেছে।  আমার মাকে দেখেছি, শ্বাশুড়িকে দেখেছি। আমিও চালিয়ে নিয়েছি।”

বাংলাদেশের ঘরোয়া দাবা টুর্নামেন্টে প্রাইজমানির অঙ্ক খুব কম। দু-তিনটি টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা পান চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু। কিন্তু প্রিমিয়ার দাবা লিগে সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ দল গড়ে ভালো অঙ্কের পারিশ্রমিক দিচ্ছে। জিয়ার ক্যারিয়ারে এটাই সর্বোচ্চ আয় এক মৌসুমে। লাবণ্য জানালেন, “এবার জিয়া ৮ লাখ টাকা পেয়েছে পুলিশ দলে খেলে।” এটা বাংলাদেশের যে কোনও দাবাড়ুর জন্য সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক। এর আগে মোহামেডানে খেলে জিয়া পেয়েছেন ৩ লাখ টাকা।

নতুন প্রজন্ম চাইলে জিয়ার মতো শুধু দাবাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন। তেমনটাই বললেন লাবণ্য, “জিয়াকে অনুসরণ করলে আর্থিক দিক দিয়ে কেউ সমস্যায় পড়বে না। তবে জিয়ার মতো তাকে দূরদর্শী ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।”

জিয়ার বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদ মাঝে মধ্যেই লাবণ্যকে বলতেন, “বৌমা ওকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না বানিয়ে কি ভুল করেছি? ও কি সাকসেস হতে পারবে?” উত্তরে লাবণ্য বলতেন, “অবশ্যই পারবে বাবা। সে নিজের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছে। একটা টাকাও ঋণে নেই কারও কাছে।”

শুধু দাবা থেকেই আয় করে সংসার চালিয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত।

জিয়াকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি লাবণ্য। তাকে সারাক্ষণ আগলে রাখছেন মেজ বোন সুলতান ইয়াসমিন। একজন দাবাড়ুর সঙ্গে বোনকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে কি কোনও সংশয় ছিল? ইয়াসমিন বললেন, “ আমার ছোট ভাই একটু ভেবেছিল। বলেছিল আগে গ্র্যান্ডমাস্টার হোক পরে দেখা যাবে। কিন্তু আমরা জানতাম ও ঠিকই ওপরে উঠে যাবে। ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখেছিলাম।”

বাংলাদেশের আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবও জিয়ার দেখানে পথেই হেঁটেছেন। রাজীব বলছিলেন, “জিয়া ভাইয়ের মতো আমারও কোনও আলাদা আয় নেই। শুধু দাবা খেলেই সংসার চলে। তবে এখানে যে পরিমান প্রাইজমানি তা অনেক কম।”

দাবা ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক আরবিটার হারুন উর রশীদ ১৯৮৫ সাল থেকে জিয়াকে দেখেছেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ বিমানে খেলার আগে পূরবী ক্লাবে খেলেন কিশোর জিয়া। যে দলটা গড়েন হারুন উর রশীদ।

জিয়াকে শুধু দাবা খেলাটাকে পেশা হিসেবে নিতে দেখে অবাক হারুন, “আসলে এই দেশে চাইলে কেউ এটা করতে পারবে না। কিন্তু জিয়ার পরিবার সেটা মেনেছে। জিয়া ভাগ্যবান যে তার পরিবার সমর্থন করেছে। আমার ‍খুব আশ্চর্য লাগে এটা।”

তখন জিয়া বিমান থেকে টিকিট পেতেন। টুনামেন্টের প্রাইজ মানি পেতেন। দাবা লিগেও ভালো অঙ্ক পেতেন। জিয়ার ফ্লাট কেনার ঘটনাতেও হারুনের বিস্ময়, “ ও যেখানে থাকে ওটা কীভাবে করলো? আমার কাছে আশ্চর্য লাগে। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে করেছে এটা। আসলে দাবাকে ভালোবেসেই এটা করেছে।”

ছেলে তাহসিন তাজওয়ারের সঙ্গে দাবা খেলছেন জিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

বাস্তবতা হচ্ছে এই দেশে খেলার প্রতি ভালোবাসা বেশি খেলোয়াড়দের। ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়া যেখানে বিনিয়োগ নেই। ভারতে দাবা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশে সেটাও নেই। ভারতে সেরা দাবাড়ুরা বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্টে বড় অঙ্কের প্রাইজমানি থাকে। দাবাড়ুদের সুযোগও আছে সেখান থেকে আয় করার। কিন্তু শর্তই হলো, ভালো খেলতে হবে।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান এই দেশের অপ্রতুল সুযোগ সুবিধার মধ্যে থেকেও যেটা পেরেছেন। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই গ্র্যান্ডমাস্টার যা করেছেন, মানে পেশা হিসেবে পুরোদস্তর দাবাড়ু হওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছেন। নতুন প্রজন্মের দাবাড়ুরা চাইলে এমন স্বপ্ন দেখতেই পারেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত