Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫

ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে তুলকালাম, আটক ৮০

সকাল থেকে খোলেনি হাজারী গলির দোকানপাট। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকেও বের হচ্ছেন না বাসিন্দারা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সকাল থেকে খোলেনি হাজারী গলির দোকানপাট। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকেও বের হচ্ছেন না বাসিন্দারা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটি ধর্মীয় সংগঠনকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার হাজারী গলিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। ঘটনার জের ধরে বুধবার বিকাল পর্যন্ত পুরো এলাকায় থমথমে ভাব দেখা গেছে। খোলা হয়নি অধিকাংশ দোকান-পাট।

ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার রাতে। কৃষ্ণভক্ত হিন্দুদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন হাজারী গলির পাশের মার্কেটের ব্যবসায়ী ওসমান আলী। সেখানে ইসকনকে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।

এই পোস্ট দেখে ক্ষুব্ধ লোকজন তার দোকানের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানায়। সেসময় ওসমান আলী দোকানেই ছিলেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেনাবাহিনী-বিজিবি-পুলিশের যৌথ টীম। তারা দোকান থেকে উদ্ধার করে ওসমান আলীকে নিয়ে যেতে চাইলে একদল বিক্ষুদ্ধ বাধা দেয়। তারা ওসমানকে তাদের জিম্মায় দেওয়ার দাবি জানায়।

এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হয় যৌথ বাহিনী। পরে ওসমান আলীকে থানায় রেখে হাজারী গলিতে ফিরে এসে সাঁড়াশি অভিযান চালায় বাহিনীগুলো। এই অভিযানে স্থানীয়দের বাড়ি থেকে বের করে এনে মারধরের খবর পাওয়া যায়। এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

আবার যৌথবাহিনীর ওপর ইটপাটকেল ও এসিড নিক্ষেপের অভিযোগও পাওয়া যায়।

পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

অভিযানে ৮০ জনের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা। এছাড়া যৌথ বাহিনীর কয়েক সদস্যের আহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। অভিযানে বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে এসিড ছোঁড়ার অভিযোগও এসেছে।

অভিযানের পর সিলগালা করে দেওয়া হাজারী গলির বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ পরিস্থিতিতে পুরো এলাকায় দেখা গেছে থমথমে অবস্থা, স্থানীয়রা রয়েছেন আতঙ্কে। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরও হচ্ছেন না বাসিন্দারা।

যৌথবাহিনী যা বলছে

পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে বুধবার দুপুরে নগরীর দামপাড়ায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করে যৌথবাহিনী। সেখানে ৮০ জনকে আটকের কথা জানানো হয়।

যৌথবাহিনীর পক্ষে টাস্কফোর্স-৪ এর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাচাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলছে। আটক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট থানায় প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদসহ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে হস্তান্তর করা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং হাজারী গলিসহ নগরীর অন্যান্য এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।”

হাজারি গলির কিছু দোকান কেন সিলগালা করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যেহেতু ওই এলাকায় সেনা ও পুলিশ সদস্যের ওপর এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে তাই ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দোকানগুলো সিলগালা করা হয়েছে।  আমরা সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বেড়াচ্ছি। দ্রুতই তদন্ত কাজ শেষ করে দোকানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা হবে।”

আটক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দুষ্কৃতকারীদের কোনও পলিটিক্যাল পরিচয় আসে না। তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নেই।”

সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‍্যাব) একজন করে প্রতিনিধি।

গতকালকের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, “একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ওসমান আলী ও তার ভাইকে হত্যা ও দোকানে আগুন দেওয়ার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ৫০০ থেকে ৬০০ দুষ্কৃতকারী হাজারী লেনে জড়ো হয়। কন্ট্রোল রুম থেকে খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছে যৌথবাহিনীর ছয়টি টহল দল।”

তিনি বলেন, “বিশৃঙ্খলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জানমাল রক্ষা এবং মবজাস্টিস রোধে যৌথবাহিনী ওসমান আলী ও তার ভাইকে উদ্ধার করে। উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানের বিষয়টি আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও একপর্যায়ে উগ্র বিশৃঙ্খলাকারীরা আরো আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে। দুর্বৃত্তরা এসময় যৌথবাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড হামলা চালায় এবং ভারী ইটপাটকেলসহ ভাঙা কাঁচের বোতল ছুড়তে শুরু করে।”

“এতে সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্য এবং সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়। আহত সেনাসদস্যদের চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”

উদ্ধার অভিযানের পর দুর্বৃত্ত শনাক্ত করতে যৌথবাহিনীর ১০টি টহল দল আনুমানিক ৯টার দিকে ওই এলাকায় আবার যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এসময় লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতিকারীরা ফের যৌথবাহিনীর ওপর এসিড সদৃশ তরল ছুড়তে শুরু করে। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৮০ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়।”

সরগরম হাজারী গলি এখন নীরব

রাতের ঘটনার পর হাজারী গলিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

নগরীর পাইকারী ওষুধের বাজার হিসেবে পরিচিত হাজারী গলি। পুরো গলিতে কয়েকশ দোকান আছে যেখান থেকে পাইকারি ও খুচরা ওষুধ কিনে নিয়ে যান আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা। স্বর্ণপট্টি হিসেবেও এই গলির খ্যাতি আছে।

ফলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দারুণ সরগরম থাকে হাজারী গলি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, সকাল থেকে অস্বাভাবিক নীরব হাজারী গলি। পাইকারী মার্কেট হিসেবে পরিচিত টেরিবাজার সংলগ্ন হাজারী গলির ফটকটি বন্ধ রয়েছে। সেখানকার দোকানগুলোর দরজায় ঝোলানো তালা সিলগালা অবস্থায় রয়েছে।

অনেক কর্মচারীকেই দোকানে গিয়ে বন্ধ দেখে ফিরে যেতে হয়েছে।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, রাতে যৌথবাহিনীর সদস্যদের লাটিপেটায় অনেক মানুষ আহত হয়েছেন। অনেক দোকানের মালিক ও কর্মচারিকে ধরেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিশৃঙ্খলার দায় বহিরাগতদের

যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে স্থানীয়দের আটক করলেও, ঘটনাস্থলের আশপাশের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা বলছেন মূল ঘটনায় বিশৃঙ্খলাকারীরা বেশিরভাগ ছিলেন বহিরাগত।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন বাসিন্দারা।

কয়েকজন বাসিন্দা ও দোকান মালিক দাবি করলেন, ওসমানের দোকান ঘিরে যে উত্তেজনা তৈরি হয় তাতে অনেক বহিরাগত এসে যুক্ত হন। তারা দোকান ভাংচুরেরও চেষ্টা করে। পরে সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে পুলিশ ও সেনাবাহিনী।

এসময় বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত জনতাকে শান্ত হতে অনুরোধ করেন দোকান মালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু যে বহিরাগতরা এসেছিলেন তারা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন বলে দাবি স্থানীয়দের।

তারা বলছেন, এরপরই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বহিরাগতরা ঘটনা ঘটিয়ে চলে যেতেই যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আসেন এবং লাঠিপেটা করেন। সেইসঙ্গে স্থানীয় অনেককে আটক করে নিয়ে যান।

লাঠিপেটায় অন্তত শতাধিক স্থানীয় আহত হয়েছে বলেও দাবি তাদের।

চমেকে আহত ৫৬ জন

লাঠিপেটায় আহতদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাপাতালে চিকিৎসা নিয়েঝেন।

বুধবার হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন জানান, হাজারী গলিতে যৌথবাহিনীর অভিযানের পর আহত অন্তত ৫৬ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত