Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

‘খেলতে গেছিলাম, গুলি করল ক্যান?’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি মোহাম্মদ কাওসার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি মোহাম্মদ কাওসার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারতলায় সার্জারি ওয়ার্ডে শুয়ে আছে ৯ বছরের এক শিশু। নাম তার মোহাম্মদ কাওসার। পেটে ব্যান্ডেজ বাঁধা। পাশে একটি টুলের ওপরে রাখা ক্যাথেটার।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কাওসারের পেটের পেছনের দিকে গুলি লেগেছে। সেটি এখনও সেখানেই আছে। সময় হলে অস্ত্রোপচার করা হবে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী সহিংসতার শিকার এই কাওসার। সে আন্দোলন বা এর পরবর্তী সহিংসতা কিছুতেই যুক্ত ছিল না। তারপরও তাকে গুলি করা হয়েছে। রক্তে ভেসে যায় তার ছোট্ট শরীর।

উত্তরার আব্দুল্লাহপুরে এক বস্তিতে ফুফুর সঙ্গে থাকে কাওসার। এই ফুফু তার রক্তের সম্পর্কের নন। দুনিয়ায় বলতে গেলে কাওসারের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। বাবা মারা গেছে। মা থেকেও নেই। মানসিক রোগী তিনি। পথে পথে ঘুরে বেড়ান।

হাসপাতালে কেন, পেটে ব্যান্ডেজই বা কেন জানতে চাওয়া হলে সকাল সন্ধ্যাকে কাওসার বলে, “১৯ জুলাই বিকালে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গোলাগুলি হইতেছিল। বন্ধু ইব্রাহিম আইসা খেলতে ডাকল। আমি যাইতে চাই নাই। ইব্রাহিম কইল, ‘আমরা তো এইখানে থাকমু। গুলি অনেক দূরে। আমাদের শরীরে লাগব না। এইট্টু খেইলাই যামু গা।

“কিন্তু একটু পর দেখলাম, পুলিশ কাছে আইতাছে। গুলি চালাইতাছে। ছাদে উইঠা টার্গেট করতাছে। তখনই দিলাম দৌড়।”

একটু দম নিয়ে সে বলতে শুরু করে, “আমরা ভাবছিলাম, পুলিশ বা আন্দোলনকারীরা যদি কাছাকাছি চইলা আসে, যদি পায়ের নিচে আমরা পইড়া যাই, তাইলে তো আর বাঁইচা থাকমু না। সেইজন্য দৌড় দিছিলাম। তখনই পুলিশ গুলি করছে। অনেক রক্ত গেছে আমার শরীর থেইকা।”

কাওসারের কথার মধ্যেই চলে আসেন তার ফুফু রিনা খাতুন। শিশুটির মা-বাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কাওসারের বাপ অনেক আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গ্যাছে। এরপর তার মা পাগলের মতো হইয়া গেল। দুই ছেলের খোঁজ নেয় না। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। ক্ষুধা পাইলে দোকানে গিয়া খাবার চাইয়া খায়। রাস্তাতেই ঘুমায়।”

রিনা খাতুন জানান, আব্দুল্লাহপুরের বস্তিতে কাওসারের পরিবার আর তার পরিবার পাশাপাশি থেকেছেন বহু বছর। কাওসারের বাবার মৃত্যুর সময় সে তার মায়ের গর্ভে ছিল। তার বড় ভাইয়ের বয়স তখন আড়াই বছর।

কাওসারের ফুফু বলেন, “বাপ মারা গেলে বস্তির কয়েকজন মিইল্যা তার মায়রে দেখাশুনা করে। এরপর কাওসারের জন্ম হইলে তারে আমি নিয়া নেই। তার বড় ভাইরে নেয় আরেকটা ঘর। তখন থেকে কাওসার আমারে ফুফু ডাকে।”

১৯ জুলাই শুক্রবার কাওসারের গায়ে গুলি লাগল কীভাবে-এই প্রশ্নের জবাবে রিনা খাতুন বলেন, “আগের রাইত থাইকাই তো গন্ডগোল। শুক্রবার সকালে সবাই কইতাছিল, উত্তরা-আব্দুল্লাহপুরে গন্ডগোল লাগছে। তাই কাওসাররে কইছিলাম, ‘জুম্মার নামাজের পর ভাঙারীর দোকানে চইলা আইয়ো। কোনও দিকে যাইয়ো না আজকে। গন্ডগোল হইতেছে।’

“কিন্তু দুপুরের খাওয়ার পরই আশেপাশের পোলাপান তারে ডাইকা নিল। তারা কইতাছিল, একটু দেইখাই চইলা আইমু। এরপর সে বাইরে গেল ওদের সঙ্গে। কিছু সময় পর শুনি, কাওসারের গায়ে গুলি লাগছে।”

কাওসারের গুলি লাগার খবর পেয়ে তার খোঁজে বের হন রিনা খাতুন ও তার স্বজনেরা।

তিনি বলেন, “হাসপাতালে হাসপাতালে খুঁজতে লাগলাম আমরা। কোথাও কাওসাররে পাই না। তখন উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে গিয়া আমার ভাই তার ছবি দেখাইলে সেখানকার একজন জানায়, গুলি লাইগা ছোট দুইটা ছেলে সেখানে ভর্তি আছে। সেখানে শেষমেশ কাওসাররে পাই।”

কাওসারকে পরে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।    

রিনা খাতুন বলেন, “এখানকার ডাক্তাররা কইছেন, তারা সময় হলে কাওসারের পেট থিকা গুলি বাইর করবেন। তার সারতে নাকি অনেক সময় লাগব। আমাদের তো নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। ওর চিকিৎসা কী দিয়া করামু? ছেলেডারে এহন ক্যাডা দেখব? চিকিৎসার দায়িত্ব ক্যাডা নিব?

রিনা খাতুনের কথা শেষ হওয়ার পর কাওসার নালিশ জানিয়ে বলে ওঠে, “আমি তো আন্দোলনে যাই নাই। খেলতে গেছিলাম, গুলি করল ক্যান? ওইখানে তো পুরাটাই ফাঁকা ছিল। গুলি ক্যান চালাইলো তারা?”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত