পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সংস্কৃতির অবসান চায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ। ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে পুলিশ সংস্কার কমিশনের চালোনো এক অনলাইন জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনীর ব্যবহারের অবসান চেয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধ চেয়েছে ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
আর গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবেচনায় অপরাধী পুলিশকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দিয়েছে ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ।
গত ৩১ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই জরিপের ফলাফল গত রবিবার প্রকাশ করা হয়েছে। এতে অংশ নেয় ২৪ হাজার ৪৪২ জন, যাদের ৪২ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছর।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চাকরিজীবী ৩৬.৪ শতাংশ, ছাত্র ২৭.২ শতাংশ, ব্যবসায়ী ৭.৬ শতাংশ এবং ইঞ্জিনিয়ার ৭.১ শতাংশ।
জরিপে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশ নিয়েছে ঢাকা জেলা থেকে। মোট উত্তরদাতার ২০.৩ শতাংশই ঢাকার। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের ৭.৫ শতাংশ ও কুমিল্লার ৫ শতাংশ।
সংস্কারের মাধ্যমে কেমন পুলিশ চান- জরিপে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক মতামত পড়েছে দুটি ক্ষেত্রে।
প্রথম স্থানে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ (৮৮.৭ শতাংশ) ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আইনের প্রতি অনুগত/নিরপেক্ষ পুলিশ (৮৬.২ শতাংশ)। আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ (৮৪ শতাংশ) এর মতো বিষয়।
জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা ভুয়া বা গায়েবী মামলার অপসংস্কৃতির সংস্কার চেয়েছে। ভুয়া বা গায়েবী মামলার ভয়ভীতির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা চেয়েছে ৮১.৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
মৃতব্যক্তি, অনিবাসী বা নিরপরাধ ব্যক্তির নামে অভিযোগ দায়েরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা চেয়েছে ৭৪.৫ শতাংশ উত্তরদাতা। আর সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা সংস্কার করে থানার ওসির কাছে প্রাক-যাচাইয়ের আইনগত ক্ষমতা প্রদান সমর্থন করেছে ৬৯.২ শতাংশ উত্তরদাতা।
জরিপে আরও দেখা গেছে, বিক্ষোভ মিছিল ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের শাস্তি চেয়েছে ৭১.৫ শতাংশ উত্তরদাতা।
এজন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিস্থাপিত প্রমিত পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণকে প্রবিধানভুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছে ৬৮.৮ শতাংশ উত্তরদাতা। এ ছাড়া মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত পুলিশ সদস্যকে উৎসাহিত করতে বার্ষিক কর্মমূল্যায়নে পুরস্কার ও তিরষ্কারের ব্যবস্থা রাখর পক্ষে ৬৮.২৭ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছে।
সভা-সমাবেশ আয়োজনে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনের পূর্বানুমতি গ্রহণকে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী মনে করে ৫১.৮ শতাংশ মানুষ। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিকাশে ৭১.২ শতাংশ উত্তরদাতা বিধানটির পরিবর্তন চেয়েছে।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, উত্তরদাতাদের ৮২.৫ শতাংশ মনে করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা বিধানটি সহজে অপব্যবহারযোগ্য আইন। ৪৬.২ শতাংশ ধারাটির যুগোপযুগী সংস্কার চেয়ছে। আর ৩৯.৭ শতাংশ উচ্চ আদালতের সুপারিশমতো সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৯১.৭ শতাংশ মানুষ পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের ধারাটিরও সংশোধন/সংস্কার চেয়েছে। তাদের মধ্যে ৮০.৯ শতাংশ উত্তরদাতা নারী আসামিকে যথেষ্ঠ শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদের পক্ষে মতামত দিয়েছে। আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিথানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ ব্যবস্থা সম্বলিত আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ থাকার পক্ষে মত দিয়েছে ৮০.২ শতাংশ মানুষ।
তল্লাশির সময় পুলিশ পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা বিনা সার্চ ওয়ারেন্টে তল্লাশি করতে চাইলে তার প্রতিকারে একটি কার্যকর কল সার্ভিস চালুর পক্ষে মত দিয়েছে ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা রাতের বেলায় গৃহ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি চেয়েছে।
এছাড়া পুলিশের অভিযানের সময় জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ পোশাক পরিধানের উপর জোর দিয়েছে ৭৭.৪ শতাংশ মানুষ।
জরিপে আরও দেখা যায়, ২৬.৭ শতাংশ মানুষ মনে করে ‘ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার’ এর সেবার কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। ৪৫.৮ শতাংশ মানুষ মনে করে ‘কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং কার্যক্রম’ সন্তোষজনক নয়। ‘অনলাইন জিডি কার্যক্রম’ এর মানও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করে ৪৪.৯ শতাংশ মানুষ।
জরিপে দেখা গেছে, শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় পুলিশ পরিচালিত ‘নারী, শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ডেস্ক’ এর কার্যক্রম নিয়ে অসন্তুষ্ট অনেক মানুষ। সাইবার হুমকি ও সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী মেয়েদের সহায়তার জন্য চালানো অনলাইন কার্যক্রমটি নিয়ে ৭২.১ শতাংশ উত্তরদাতা সন্তুষ্ট বা অবগত নয় বলে জানিয়েছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা একটি স্বাধীন সংগঠনের মাধ্যমে তদন্তের পক্ষে মত দিয়েছে। পুলিশকে জবাবদিহি ও বিভিন্ন প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা কমিশনের পক্ষে মত দিয়েছে ৫৮.৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় পুলিশের জন্য স্বাধীন ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দিয়েছে ৪১.১% শতাংশ উত্তরদাতা।