দেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ দিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। নতুন বাজেট পেশের আগের দিন বুধবার সরকারি সংস্থাটি রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪০৭ কোটি (৪.০৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রায় ২৪ শতাংশ।
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত- যে খাত থেকে ৮৫ শতাংশের বেশি আসে, সেই তৈরি পোশাক থেকে মে মাসে রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ।
টানা চার মাস পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি আয় হওয়ার পর গত এপ্রিল মাসে হোঁচট খায় রপ্তানি আয়; নেমে আসে ৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ—এই চার মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল।
সংকটের এই সময়ে পর পর দুই মাস রপ্তানি আয় হোঁচট খাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এতে উদ্বেগের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আরও চাপের মধ্যে পড়বে।
২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে ২০২৪-২৫ অর্থবছর।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের মে মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৩৩ কোটি ৯০ লাখ (৫.৩৪ বিলিয়ন) ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের মে মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।
গত এপ্রিলে ৩৯১ কোটি ৬৯ লাখ (৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল, যা ছিল গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ১ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
গত বছরের নভেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। একক মাসের হিসাবে এই অঙ্ক এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি করে ৫১৮ কোটি ৭৫ লাখ (৫.১৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে আনেন রপ্তানিকারকরা। মার্চে এনেছিলেন ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ বেশি।
তবে ৫৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যের চেয়ে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
গত বছরের অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল তার আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ছিল ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
গত বছরের অক্টোবরের রপ্তানি আয় ছিল ২৬ মাস পর সবচেয়ে কম।
২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। তবে পরের মাস নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বাড়ে; আসে ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার। ডিসেম্বরে এক লাফে বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের তিন মাসেও ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে আসে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে টানা তিন মাস (অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি কমায় ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির গতি কমে দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে আসে।
জানুয়ারিতে রপ্তানি বাড়ায় প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও বেড়ে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশে ওঠে। মার্চ শেষে বেড়ে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ হয়।
এপ্রিল ও মে মাসে কমায় অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রবৃদ্ধি কমে ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
৮৫.০৭ শতাংশ এসেছে পোশাক থেকে
চলতি বছরের জুলাই-মে মাসে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ৪৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ২৪ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৯ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এই ১১ মাসে পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৪২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির হিসাব বলছে, এই ১১ মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পর পর দুই মাস রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা এখনও লেগে আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাবারের পেছনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে।
“জানি না এই অবস্থা কতোদিন যাবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। সরকারি নীতি সহায়তা ছাড়া এখন আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই। আমাদের অর্ডার কমছে। আগামীতে রপ্তানি আরও কমবে বলে মনে হচ্ছে। গ্যাস সংকট লেগেই আছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো না। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি বাড়ার আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।”
অর্থনীতির গবেষক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এই সংকটের সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পাশপাশি রপ্তানি আয় বাড়ায় এক ধরনের স্বস্তি ছিল। এই দুই সূচক না বাড়লে রিজার্ভ আরও কমে যেত।
“কিন্তু এপ্রিলের পর মে মাসেও রপ্তানি কমায় উদ্বেগ বাড়ল। রিজার্ভের পতন ঠেকানো কঠিন হবে।”
অন্যান্য খাত
তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। জুলাই-মে সময়ে হিমায়তি মাছ রপ্তানি কমেছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।
তবে এই ১১ মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।