দেশে গত চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়েনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুদহার সমন্বয় না হওয়ায় মুনাফা তো মিলছেই না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমানতকারীরা।
ব্যাংক খাত নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি হোটেলে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
‘হোয়াট লাইস এহেড ফর দ্য ব্যাংকিং সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই প্রবন্ধে দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে সিপিডি।
সিপিডির হিসাব বলছে, ব্যাংকে আমানত রেখে সর্বশেষ মুনাফা পাওয়া গেছে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ওই মাসে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশীয় পয়েন্ট। তা ওই বছর মার্চে তা শূন্যের কোটায় পৌঁছে। এরপর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রতিমাসেই মূল্যস্ফীতির তুলনায় সুদহার ঋণাত্মকের ঘরে রয়েছে।
এর মধ্যে ২০২২ সালের আগস্ট ও ২০২৩ সালের মে মাসে এই হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট ঋণাত্মক ছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে তা সবসময় ওঠানামা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৪ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট নামে বলে সংস্থাটির প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিপিডির প্রধান নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের আর্থিক খাত ব্যাংকনির্ভর। দেশের উন্নয়নে এ খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অথচ সেই ব্যাংক খাতে ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে। সুশাসন-জবাবদিহিতার হরণ ঘটেছে। ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফশিল, অবলোপন সবই নিজেদের মতো করে করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাইরের চাপে কিংবা নিজেরা ইচ্ছা করে স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। এ অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
এখানে বলে রাখা দরকার, ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংক খাতে উচ্চ হারে সুদহার নেওয়া হতো। এতে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায় খরচ বাড়ছে—এমন যুক্তি তুলে ধরে ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেয় সরকার। ওই বছরের এপ্রিল থেকে শুরু হয় আলোচিত ‘নয়-ছয়’ সুদহার।
পরে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার সামাল দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তে ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়া হয় গত বছরের জুলাইতে। তখন থেকে প্রতিমাসে ‘স্মার্ট’সুদহারের নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের ১ জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে ওই নিয়ম চালু করে। ওই নিয়মে সুদহার নির্ধারণ হয় ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের ওপর, যার নাম ‘সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড়) বা স্মার্ট রেফারেন্স রেট।
ওই হার নির্ধারণের ৯ মাস না যেতেই গত ৯ মে থেকে ‘স্মার্ট রেট’থেকে সরে এসে বাজারভিত্তিক সুদহার পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো এখন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নিজেরাই সুদের হার নির্ধারণ করবে।
সিপিডি বলছে, ২০২১ সালের ৮ আগস্ট মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বলা হয়েছিল, মূল্যস্ফীতির তুলনায় কখনোই আমানতের সুদহার কম হবে না। এখন আবার অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করতে সুদহার বাড়িয়েছে। তবে প্রায় চার বছরে ধরে মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির মুখে পড়ছে।
সিপিডির প্রবন্ধটির প্রধান গবেষক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ভুল তথ্য দিয়ে নীতি ভুল হবেই। উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে রিয়েল টাইম তথ্য পাওয়া যায় । অথচ আমাদের এখানে সেটা তো পাওয়াই যায় না বরং তথ্য সংগ্রহের দরজা বন্ধ করা হয়েছে।”
ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “ব্যাংক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চরম অবনতি হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাতে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করছে।
“বিশেষ করে, গত দুই বছরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়েনি।”
ব্যাংক খাতের ঋণ পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “২০২২ সাল শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এরসঙ্গে অর্থঋণ আদালতের মামলায় আটকে থাকা এক লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খারাপ ঋণ আরও বেশি।
“বলা হচ্ছে, সরকারি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গড়া হবে। এসব কোম্পানিকে আর্থিক সহায়তা সরকার দেবে। কিন্তু এই কোম্পানি যে ভালো হবে তার সম্ভাবনা কী? এই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অর্থ তো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেওয়া হবে। যদি ব্যাংকগুলো দেখে খারাপ ঋণগুলো এখানে বিক্রি করে দেওয়ার সুযোগ আছে, তাহলে তারাও এই সুযোগ নেবে। এতে একটি সাইকেল তৈরি হবে।”
দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “নিয়ন্ত্রণ যারা করেন, তাদের শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সকালে এক রকম নিয়ম করে, বিকালে আবার আরেকজনের কথা শুনে তা পরিবর্তন করে। আইন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন দিলেও, তা অর্জন করা হয়নি এখনও।”
সুদহার ও ডলারের দর অনেক আগেই বাড়ানো দরকার ছিল মন্তব্য করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, “এটা না করায় মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, ডলারের দর বাড়িয়ে কিংবা সুদহার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি হবে না। প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প এবং কৃষিতে ঋণ বাড়াতে হবে।”