প্রতি বছর হাজার হাজার দক্ষিণ কোরিয়ান— বেশিরভাগ মধ্যবয়সী পুরুষ— তাদের পরিবার ও স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং একাকী মারা যায়। কখনও কখনও তাদের মৃতদেহ খুঁজে পেতেও কয়েক দিন বা এমনকি সপ্তাহ লেগে যায়।
এমন মৃত্যুকে দেশটিতে বলা হয় নিঃসঙ্গ মৃত্যু, কোরিয়ার ভাষায় যা ’গোডোকসা’ নামে পরিচিত। এটি সারাদেশে একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার একটি বৃহত্তর সমস্যার অংশ। ফলে সমস্যাটি মোকাবেলার জন্য দেশটির সরকার যতভাবে সম্ভব সব পদক্ষেপ নিচ্ছে।
কোলাহলপূর্ণ রাজধানী সিউলের শহর কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছে, তারা আগামী পাঁচ বছরে ৪৫১.৩ বিলিয়ন ওন (৩২৭ মিলিয়ন ডলার) ব্যয় করবে ‘এমন একটি শহর তৈরি করতে যেখানে কেউ নিঃসঙ্গ থাকবে না’।
তাদের নতুন উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে দিনের ২৪ ঘণ্টাজুড়ে হটলাইনে নিঃসঙ্গতা বিষয়ক পরামর্শ, অনুরূপ কাউন্সেলিংয়ের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সেইসঙ্গে নগর সরকারের মতে, ব্যক্তিগত পরিদর্শন এবং পরামর্শ সহ ফলো-আপ ব্যবস্থা।
সিউলের মেয়র ওহ সে-হুন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, “নিঃসঙ্গতা এবং বিচ্ছিন্নতা শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং সামাজিক সমস্যাও, যা সবাই মিলে সমাধান করতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের শহরের সমস্ত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের নিরাময় করতে এবং সমাজে ফিরে যেতে সাহায্য করব।”
শহর কর্তৃপক্ষ প্রসারিত মনস্তাত্ত্বিক পরিষেবা এবং সবুজ স্থান তৈরি; মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক বাসিন্দাদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের পরিকল্পনা; সাহায্যের প্রয়োজন এমন বিচ্ছিন্ন বাসিন্দাদের সনাক্ত করার জন্য একটি নিবেদিত অনুসন্ধান ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা করেছে।
এছাড়া মানুষকে ঘরের বাইরে বের হওয়ার উদ্যোগ নিতে এবং অন্যদের সঙ্গে সংযোগ, যেমন বাগান করা, খেলাধুলা, বুক ক্লাব এবং নানা সামাজিক তৎপরতা চালাতে উৎসাহিত করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে আরও বেশি কিছু করা দরকার বলেও জানিয়েছেন তারা। কারণ নিঃসঙ্গতা কোরিয়ান সংস্কৃতির এমন কিছু অংশের সঙ্গে যুক্ত যা পরিবর্তন করা কঠিন।
মায়ংজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আন সু-জং বলেছেন, “নিঃসঙ্গতা এই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা, তাই এটি মোকাবেলায় প্রচেষ্টা চালানো বা নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।”
তবে সতর্ক করে দিয়েছেন, “কতটা কার্যকরভাবে এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হবে তা সতর্কভাবে বিবেচনারা দরকার আছে।”
হাজারো নিঃসঙ্গ মৃত্যু
নিঃসঙ্গতার সমস্যাটি গত এক দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারণ এ সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, তরুণরা যারা স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে যায় এবং বাড়িতে একাকি সময় কাটায়, কখনো এমনকি এক নাগাড়ে কয়েক মাস।
এমন ঘটনাকে জাপানি ভাষায় ‘হিকিকোমোরি’ বলা হয়। ঘটনাটি ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠেছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ধরনের ঘটনা ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজারটি।
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে, যা গত বছর ৩ হাজার ৬৬১টিতে পৌঁছেছে। আর ২০২২ সালে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ৩ হাজার ৫৫৯টি এবং ২০২১ সালে ঘটে ৩ হাজার ৩৭৮টি। গত সপ্তাহে দেশটির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয় ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যুর’ নতুন এবং আরো বিস্তৃত সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সেজন্যও এই সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এর আগে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য শুধুমাত্র ‘নির্দিষ্ট সময়’ পরে মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়ার শর্ত ছিল।
কিন্তু শব্দটি এখন এমন যেকোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় থাকেন, পরিবার বা আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং মৃত্যুবরণ করেন আত্মহত্যা বা অসুস্থতার জন্যও।
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর এই সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে দেশের জনসংখ্যাগত সংকট। বৃদ্ধ জনসংখ্যা বেশি হওয়া এবং ক্রমহ্রাসমান জন্মহার মানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জন্মের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি মৃত্যু হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সামগ্রিক মৃত্যুর হার বাড়ছে এবং এর মধ্যে নিঃসঙ্গ মৃত্যুও রয়েছে।
কিন্তু পরিসংখ্যানগুলো থেকে একটি বৃহত্তর সমস্যারই ইঙ্গিত মেলে, যা মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক পুরুষদেরকেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে বলে মনে করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর রেকর্ড করা নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঘটনার ৮৪ শতাংশেরও বেশি ছিল পুরুষ, যা নারীর নিঃসঙ্গ মৃত্যুর সংখ্যার পাঁচ গুণেরও বেশি। দেশটির পুরুষদের অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৫০ ও ৬০ বছরের উপরে এবং এই বয়সীদেরই নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
কোরিয়ানরা কেন এত নিঃসঙ্গ
মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আন বলেছেন, “নিঃসঙ্গতা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য নতুন নয় এবং এটাও বলা কঠিন যে, কোরিয়ানরা অন্যদের তুলনায় বেশি নিঃসঙ্গ। যাইহোক, তাদের নিঃসঙ্গতার কারণের সঙ্গে অন্যান্য দেশের কিছু পার্থক্য রয়েছে।”
আন বলেন, কিছু সংস্কৃতিতে নিঃসঙ্গতাকে একটি অনুভূতি হিসাবে দেখা হয়, যা তখনই ঘটে যখন সম্পর্কগুলো পরিপূর্ণ হয় না। কোরিয়াতে লোকেরা বলেন যে, তারা খুব একা বোধ করেন যখন তারা মনে করেন যে তারা যথেষ্ট যোগ্য নয় বা উদ্দেশ্যের অভাব রয়েছে।”
আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞও একই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করেছেন। একজন পূর্বে সিএনএনকে বলেছিলেন, মিলেনিয়াল এবং জেন জি প্রজন্মের কোরিয়ানরা সমালোচনার প্রতি বেশি সংবেদনশীল। এ ছাড়া তারা অত্যধিক আত্ম-সমালোচক এবং ব্যর্থতার ভয়ে ভীত।
এ বছরের জুনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিঃসঙ্গতার মহামারী কোরিয়ান সংস্কৃতির সূক্ষ্ম তারতম্যগুলোকে প্রতিফলিত করে, যা ‘সম্পর্কগত অভিযোজনে জোর দেয়’— বা লোকে নিজেকে তাদের আশেপাশের অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করে।
ফলস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়ানরা গভীর একাকীত্ব বা ব্যর্থতার অনুভূতি অনুভব করতে পারেন যদি তারা মনে করেন যে, তারা ‘অন্যদের বা সমাজের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছেন না’।
অধ্যাপক আন বলেন, এটি অন্যান্য দেশ থেকে একটি প্রধান পার্থক্য। কোরিয়ানদের একটি সমৃদ্ধশালী সামাজিক জীবন এবং অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকতে পারে। কিন্তু এরপরও তারা একাকি বোধ করতে পারেন ‘যখন তারা নিজেদেরকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করেন এবং প্রশ্ন করেন যে সমাজে তাদের দরকার কতটুকু, তারা কি সমাজে যথেষ্ট অবদান রাখছেন, নাকি পিছিয়ে পড়ছেন’।
সমীক্ষায় আরও কিছু কারণও চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, একাকি বসবাস করা, কাজ ও পরিবারের বাইরে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া কমা, সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্য এবং তার ফলে অপর্যাপ্ততার অনুভূতি। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিযোগিতামূলক ‘অর্জন-ভিত্তিক’ সংস্কৃতিও যারা নিজস্ব লক্ষ্যে অর্জনে অক্ষম তাদের মধ্যে একাকীত্বের অনুভূতি তৈরি করে।
আন বলেন, “যখন আমরা সবাই একই মানদণ্ডকে অত্যধিকভাবে অনুসরণ করি, তখন আমরা নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলি। আমাদের সমাজ অত্যন্ত সমষ্টিগত সামাজিক জীবনযাপনের দাবি করে কিন্তু প্রায়শই ব্যক্তিকে সম্মান করতে ব্যর্থ হয়— মানে যারা একাকীত্ব বা ব্যর্থতার অনুভূতি মোকাবেলা করতে সংগ্রাম করছেন।
সরকারি প্রচেষ্টা
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে সমস্যাটি মোকাবেলায় বিভিন্ন উদ্যোগ শুরু করেছে। যেমন, একাকি মৃত্যু প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইন। এই আইন সরকারকে একটি ব্যাপক প্রতিরোধমূলক পরিকল্পনা এবং একটি পঞ্চ-বার্ষিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে।
আর ২০২৩ সালে সরকার একটি সংশোধনী পাস করে, যার মাধ্যমে কিছু নিঃসঙ্গ যুবককে আর্থিক সহায়তা করা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানো এবং পুনরায় সমাজে প্রবেশের জন্য একজনকে প্রতি মাসে ৬ লাখ ৫০ হাজার ওয়ান পর্যন্তও দেওয়া হয়।
এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া একা নয়। জাপানে ২০২১ সালে নিঃসঙ্গতা এবং বিচ্ছিন্নতা মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। দেশটিতেই প্রথম হিকিকোমোরি বা নিঃসঙ্গতার প্রবণতা প্রথম ধরা পড়ে এবং তা নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা হয়। পরের বছরই জাপান সরকার দিনে ২৪ ঘণ্টা ধরে সচল পরামর্শ পরিষেবা ও কাউন্সেলিং এবং সামাজিক কর্মসূচি সহ নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধের একটি নিবিড় পরিকল্পনা প্রকাশ করে।
যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশও একইভাবে নিঃসঙ্গতা বিষয়কমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ২০২৩ সালে নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মহামারী সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। আর তা মোকাবেলায় শক্তিশালী সামাজিক অবকাঠামো তৈরি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মতো পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।
এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালে নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি কমিশন চালু করে এটিকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলেও অভিহিত করেছে।
কিন্তু আন বলেন, “শুধু শারীরিক যোগাযোগ বাড়ানো নিঃসঙ্গতার সমস্যাকে মৌলিকভাবে সমাধান করবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এটি এমন কিছু নয় যা একটি মাত্র নীতি দিয়ে সহজেই পরিবর্তন করা যায়।”
কারণ এর সঙ্গে জটিল সাংস্কৃতিকভাবে-নির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। আন বলেন, এর জন্য একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে যাতে ব্যক্তিরা একা থাকার এবং নিজেদের মুখোমুখি হওয়ার শক্তির বিকাশ করতে পারে।
“আমাদেরকে নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সমাজে আমাদের জীবন খুবই কঠিন, তাই মনে হয় আমাদের নিজেদের যত্ন নেওয়ারও সময়ও নেই।”
তথসূত্র : সিএনএন