Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

শেখ কামাল পুরস্কারেও গোঁজামিল !

শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে।
শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে।
[publishpress_authors_box]

জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়া যে কোনও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের কাছে আরাধ্য স্বপ্ন। ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সাধারণত এসব পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন খেলোয়াড়, সংগঠকেরা। কিন্তু কখনোই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। সেই তালিকায় যোগ হতে যাচ্ছে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন অনেকে থাকেন, যাদের জাতীয় পর্যায়ে বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে না। তবু পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম তুলতে ‘সক্ষম’ হন তারা। অনেকে তদবির করে এই পুরস্কার পেয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। এবারও সেভাবে এই পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন অনেকে- এমনই প্রচার আছে ক্রীড়ামহলে। শুধু তাই নয়, কিভাবে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের বেছে নেওয়া হয়, বাছাই কমিটির এই প্রক্রিয়া নিয়েও অনেক প্রশ্ন।

পুরস্কারের মানদন্ড অস্পষ্ট

এবার শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের আবেদনের প্রাথমিক তালিকায় ছিল কারাতে খেলোয়াড় হাসান খান ও শুটার শাকিল আহমেদের নাম। হাসান দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে জিতেছেন সোনা। পাশাপাশি ভারত, নেপালে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় জিতেছেন একাধিক সোনা। কিন্তু শাকিল কমনওয়েলথ গেমসে রুপা জিতেছেন। কিন্তু গেমসের মান অনুযায়ী কোন পদকের মান কি হবে, সেটা নিয়ে পরিস্কার কোনও নীতিমালা নেই। 

ক্রীড়াবান্ধব নয় এমন প্রতিষ্ঠানকেও দেওয়া হয়েছে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার।

আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। অ্যাথলেট ফিরোজা বেগম পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। পাশাপাশি স্বাধীনতা পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। এরপরও তিনি শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরস্কারের জন্য এবার আবেদন করেন। কিন্তু একাধিক পুরস্কার পাওয়ায় বাছাইয়ের প্রাথমিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তার নাম! তাহলে কি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া কি এই শেখ কামাল ক্রীড়া পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারবে না ? সেটারও কোনও নিয়ম-নীতি নেই। এর আগে যে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া ক্রীড়াবিদকেই দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার।  

এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এই পুরস্কারের জন্য নেই কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। শুধু বলা আছে, আজীবন সম্মাননার ক্ষেত্রে ওই খেলোয়াড় বা ব্যক্তির সারা জীবনের ক্রীড়া বিষয়ক সাফল্যের স্বীকৃতির ও অর্জনের প্রমাণাদি তথ্য জমা দিতে হবে। খেলোয়াড়ের বেলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একক ও দলগত অর্জন, দেশে বা বিদেশের কোনও স্বীকৃতি, ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনও সনদ, ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও অবদান ও অন্যান্য কিছু তথ্য থাকলে সেটা জমা দিতে হবে। এমন দশ জনের বিভিন্ন ক্রীড়া সাফল্যের তুলনামূলক বিচার বা মার্কিং কিভাবে হবে, তার কোনও নির্দেশনা নেই।

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত টেবিল টেনিস খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু বাছাইয়ের এমন অদ্ভূত প্রক্রিয়া দেখে অবাক, “এসব দেখে খুবই খারাপ লাগে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর এ ধরনের পুরস্কার ঝুড়িতে বিক্রি হবে।”

আবেদনকারী নিজেই বাছাই কমিটিতে !

মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা ফিরোজা করিম নেলী এই পুরস্কারের প্রাথমিক বাছাই কমিটির একজন সদস্য। তিনিই আবার ক্রীড়া সংগঠক ক্যাটাগরিতে আবেদন করেছেন পুরস্কারের জন্য। এটা খুব হাস্যকর এবং বিতর্কিতও। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য বলেন, “তার আবেদনের ব্যাপারটা জানার পর এনএসসির সচিব মহোদয় (প্রাথমিক বাছাই কমিটির সভাপতি) তাকে বাছাই কমিটির সভার বাইরে রাখেন।”  

ক্রীড়াঙ্গন ও ক্রীড়াবিদ সম্পর্কে বিচারকদের ধারণা নিয়ে প্রশ্ন

পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের প্রাথমিক বাছাই কমিটির সভাপতি এনএসসির সচিব আমিনুল ইসলাম।  এই কমিটির সদস্য সচিব এনএসসির পরিচালক (ক্রীড়া) এস এম শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম। সদস্যরা হলেন- ক্রীড়া জগতের সম্পাদক দুলাল মাহমুদ, সাইক্লিংয়ের সাধারণ সম্পাদক তাহের উল আলম চৌধুরী স্বপন, হকির সহ-সভাপতি ফয়সাল আহসান উল্লাহ, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা ফিরোজা করিম নেলী, বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সামছ এ খান, বিকেএসপির প্রতিনিধি উজ্জ্বল চক্রবর্তী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি এবং ক্রীড়া পরিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি। এই কমিটির কার্যপরিধি হচ্ছে প্রাপ্ত আবেদনপত্রগুলো যাচাই বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ খসড়া তালিকা তৈরি করা।

বাছাই কমিটির বিচারকদের খেলোয়াড় ও সংগঠকদের সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট, এমন দাবি টিটির মানস চৌধুরীর।

এরপর সেই তালিকা যাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে। ওই কমিটির সভাপতি ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান। বাকি সদস্য-বিকেএসপির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, এনএসসির সচিব আমিনুল ইসলাম, জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ফুটবলার আবদুল গাফফার, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মাহবুব আরা গিনি, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশেনের (বিওএ) মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ  রেজা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ক্রীড়া), পরিচালক ক্রীড়া পরিদপ্তর, বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী ফাউন্ডেশনের সচিব, সরকার কর্তৃক মনোনীত দুজন প্রতিনিধি ও এনএসসির দুজন প্রতিনিধি।

বাছাই কমিটির বিচারকরা খেলোয়াড় ও সংগঠক সম্পর্কে কতখানি ধারণা রাখেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন টেবিল টেনিসের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরী। ৫ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মানস বলেন, “বিচারকদের জানা-বোঝা ও নিরপেক্ষকতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। আমাদের মতো খেলোয়াড়দের সম্পর্কে কমিটির বেশির ভাগ লোকেরই কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তারা খাতিরের লোকজনকেই বেছে নেয়।  ফর্মের চূড়ায় থাকা অবস্থায় আমাকে কেউ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেনি। অথচ আমার চেয়ে কম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েও অনেকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জিতেছেন। এই দুঃখের কথা কাকে বলবো?” শুধু মানস নয়, বিচারকদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের।

ফরমে দেওয়া তথ্য যাচাই করবে কে?

পুরস্কারের আবেদন ফরমে দেওয়া পদক সংখ্যা বা যাবতীয় তথ্য যাচাই করবে কে? যেমন এই পুরস্কারের প্রাথমিক বাছাইয়ের কমিটিতে আছেন বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। যার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে ব্যবসা করার মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ক্রীড়াবিদ বানিয়ে নিজের ভাই, ভাবি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে অনুদান দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তা কিভাবে একজন অ্যাথলেটের পদক সংখ্যা যাচাই বাছাই করবেন? আছেন অনেক সরকারি আমলা যাদের ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কে ধারনা খুব কম। তাহলে কোনও অ্যাথলেট ফরমে ভুল তথ্য দিলে, সেটা কিভাবে তারা যাচাই করবেন ? 

বিচারকদের কর্মকান্ড নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।

যেমন এসএ গেমসে সোনাজয়ী ভারোত্তালক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বিচারকদের কর্মকান্ড নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, “অতীতে ভারোত্তোলন থেকে এমন একজন এই পুরস্কার পেয়েছেন যার একটি মাত্র আন্তর্জাতিক রৌপ্য পদক আছে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে তাকে পুরস্কার দেওয়া হলে আমার মূল্যায়ন কোথায় হলো? আমিও এই পুরস্কার পেয়েছি। তাহলে আমাকে অপমান করা হলো, নাকি সম্মান দেওয়া হলো?”

পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছেন এই কৃতি ভারোত্তোলক, “আসলে কিভাবে বাছাই হয়, এটা একটা বড় প্রশ্ন। বিচারকদের সঙ্গে যাদের খাতির তাদের পুরস্কার সম্ভাবনা বেশি মনে হয়। আসলে বাংলাদেশের পুরস্কার পাওয়ার মাপকাঠিই যেন এটা। শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের ক্ষেত্রে অনেক অযোগ্যরা আবেদন করেন, যাদের তেল মারার স্বভাব রয়েছে তারা এই পুরস্কার পেয়েও যায়। আমাদের দেশে যোগ্য লোকের কদর নেই, অযোগ্য লোকের কদর বেশি।” 

পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক

২০২৩ সালে স্পোর্টস স্পনসর পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। বিএবি পুরস্কার পাওয়ার মত ক্রীড়া বান্ধব ছিল কিনা, সেটা অনেকের প্রশ্ন।

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের মতো শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারও সহজ লভ্য হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাবেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কামরুন নাহার ডানা। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই খেলোয়াড় বলেন, “আসলে এই পুরস্কারের তালিকায় অনেক আগাছাকে আমরা দেখতে পাই। এগুলো লজ্জাজনক ব্যাপার। দিনকে দিন এই পুরস্কারগুলো খুব সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার যেমন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে, তেমনি তদবির করে পাওয়া যায় বলে এটিও এক সময় অর্থহীন হয়ে যাবে।”

শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারও হয়তো এক সময় ঝুড়িতে পাওয়া যাবে, এমন মন্তব্য টেবিল টেনিসের জোবেরা রহমান লিনুর।

যদিও শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের প্রাথমিক বাছাই কমিটির প্রধান আমিনুল ইসলামের দাবি নিয়ম মেনেই সব কিছু করা হচ্ছে, “এখানে পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম বাছাই করার ক্ষেত্রে কমিটির সবার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মিটিং শেষে সবার সই নেওয়া হয়। তাছাড়া যথাযথ প্রক্রিয়া ও নির্দেশনা মেনেই সব কিছু যাচাই বাছাই করেই চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করা হয়।”

শেখ কামালের ৭২তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২১ সালে প্রথমবার এই পুরস্কার প্রবর্তন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ৫ আগস্ট চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করবেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম।

শেষ কথা

গত ১১ জুন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে জমা পড়েছে এ বছরের শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কারের তালিকা। এরই মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমেছে । শেখ কামালের মতো দুর্দান্ত সংগঠক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের নামাঙ্কিত পুরস্কারটিও যেন গোঁজামিলের পুরস্কার হয়ে না যায়, এটাই ক্রীড়াঙ্গনের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত