Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

নোবেলের খ্যাতি কি কমিয়ে দেয় কাজের গতি

image
[publishpress_authors_box]

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একজন মানুষের জন্য জীবন বদলে দেওয়ার মতোই একটি ঘটনা। বিজয়ীদের বিশ্ব মঞ্চে প্রবেশের সুযোগ করে দেয় এই পুরস্কার। অনেক বিজ্ঞানীর কাছে এই স্বীকৃতি তাদের অনেক সাধনার ধন। কিন্তু এত বড় মাপের পুরস্কার জয় বিজ্ঞানের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে?

এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট জন ইয়োএনিডিস। তিনি বলেন, “নোবেল পুরস্কারের মতো পুরস্কার খ্যাতি এনে দেওয়ার বড় উপলক্ষ, তবে প্রশ্ন হচ্ছে– এই ধরনের পুরস্কার বিজ্ঞানীদের আরও কর্মক্ষম করে তুলতে এবং তাদের আরও প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে কি না?”

গত বছরের আগস্টে ড. ইয়োএনিডিসের নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে, যেখানে বড় মাপের পুরস্কার বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয় কি না, তা বের করার চেষ্টা হয়েছে।

নোবেল পুরস্কার বা ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ পাওয়া বিজ্ঞানীদের প্রকাশনা এবং তাদের কাজের উদ্ধৃতির ধরন ব্যবহার করে গবেষক দলটি বিশ্লেষণ করেছে, পুরস্কারপ্রাপ্তি-পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীদের উৎপাদনশীলতা বয়স ও কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায় দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয়।

সামগ্রিকভাবে এই গবেষণায় উঠে এসেছে যে, নোবেল বা ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ পাওয়া বিজ্ঞানীদের তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রভাব আগের মতো থাকে না, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কমে যায়।

ড. ইয়োএনিডিস বলেন, “এই পুরস্কারগুলো বিজ্ঞানীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় বলে মনে হয় না। এসব পুরস্কারের যদি কোনও প্রভাব থেকেই থাকে, তবে সেটি বিপরীত (নেতিবাচক) ধরনের প্রভাব বলেই মনে হয়।”

১৯০১ সাল থেকে নোবেল ফাউন্ডেশন পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে (১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনৈতিক গবেষণার জন্য পুরস্কার যুক্ত হয়) যুগান্তকারী সাফল্যের জন্য পুরস্কার দিয়ে আসছে।

ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ চালু হয় ১৯৮১ সালে, তবে নোবেল পুরস্কারের মতো পুরস্কার দেওয়ার বদলে এটি ব্যক্তির সম্ভাবনা বিবেচনায় তার পেছনে বিনিয়োগ হিসাবে মঞ্জুরি দেয়।

বয়স কীভাবে বৈজ্ঞানিক উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে, তা জানার জন্য ইয়োএনিডিসের গবেষক দল নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করেছে।

গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ প্রাপ্তদের তুলনায় নোবেল পুরস্কার জয়ীরা সাধারণত বেশি বয়স্ক এবং তাদের কর্মজীবন অনেক বেশি দীর্ঘ হয়।

ড. ইয়োএনিডিস জানান, গবেষণার অংশ হিসেবে তার দল এই শতাব্দীর ৭২ জন নোবেল বিজয়ী এবং ১১৯ জন ম্যাকআর্থার ফেলোর একটি নমুনা নির্বাচন করে এবং স্বীকৃতি পাওয়ার তিন বছর আগে করা তাদের প্রকাশনা ও তাদের কাজ উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহারের সংখ্যার সঙ্গে স্বীকৃতি-পরবর্তী তিন বছরে তাদের প্রকাশনা ও উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার হওয়ার সঙ্গে তুলনা করে।

এসব প্রকাশনার বিশ্লেষণ একজন ব্যক্তি কতটা নতুন কাজ করতে পেরেছেন, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর পাশাপাশি উদ্ধৃতি হিসেবে তাদের প্রকাশনার ব্যবহার নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব কেমন তা নির্দেশ করে।

১৯০১ সাল থেকে নোবেল ফাউন্ডেশন পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে যুগান্তকারী সাফল্যের জন্য পুরস্কার দিয়ে আসছে।

গবেষক দলটি দেখতে পেয়েছে, নোবেল বিজয়ীরা পুরস্কার পাওয়ার পর একই সংখ্যক প্রকাশনা বের করেছেন, তবে পুরস্কার-পরবর্তী কাজগুলো পুরস্কার পাওয়ার আগের সময়ের কাজের তুলনায় উদ্ধৃতি হিসাবে অনেক কম ব্যবহৃত হয়েছে।

অন্যদিকে, ম্যাকআর্থার ফেলোদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ফেলোশিপ পাওয়ার পর বের হওয়া তাদের প্রকাশনার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তাদের কাজগুলো উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহারের সংখ্যা প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে।

সার্বিকভাবে নোবেলবিজয়ী ও ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ পাওয়া ব্যক্তিদের কাজ উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহারের সংখ্যা তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার পর কমেছে।

বয়সের প্রত্যক্ষ প্রবণতা বিশ্লেষণ করার সময় দলটি দেখেছে যে, ৪২ বছর বা তার বেশি বয়সী বিজয়ীদের ক্ষেত্রে নোবেল বা ফেলোশিপ পাওয়ার পর তাদের প্রকাশনা বা কাজ উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহারের সংখ্যা কমতে থাকে। এক্ষেত্রে যাদের বয়স ৪১ বছর বা আরও কম তাদের ক্ষেত্রে প্রকাশনার সংখ্যা এবং উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার হার বেশি।

গবেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা নির্দেশ করে যে, পুরস্কার বিজয়ীদের বৈজ্ঞানিক উৎপাদনশীলতায় বয়স ভূমিকা রাখে।

তবে দীর্ঘ সময় ধরে নোবেলবিজয়ীদের জীবন ও কাজ অনুসরণ করে আসা কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী হ্যারিয়েট জাকারম্যানের মতে, এই ধরনের সহজ হিসাব-নিকাশ দিয়ে উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া কঠিন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র জুড়ে সাধারণীকরণ করা হলে এই সমস্যা আরও বাড়ে। কিছু ক্ষেত্রে, উদাহরণস্বরূপ, নবীন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণায় যুক্ত থাকলেও নবীনরা যাতে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য জ্যেষ্ঠ অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা-প্রবন্ধে তাদের নাম যুক্ত করতে চান না।

যদিও ডা. জাকারম্যান এটিকে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে তুলনা করেন না, তবে তিনিও নোবেলবিজয়ীদের প্রকাশনা এবং সেগুলো উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহারের ধরন তাদের বয়স, কর্মজীবনের পর্যায় ও অন্যান্য কারণের সঙ্গে কীভাবে ওঠানামা করে, তা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

তিনি দেখতে পেয়েছেন, খ্যাতির অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটায়। নোবেলবিজয়ীরা কোনও না কোনোভাবে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও ম্যাকআর্থার ফেলোরা নাও হতে পারেন।

জাকারম্যান বলেন, “বিজ্ঞান বলয়ের বাইরের লোকজন প্রায়ই নোবেলবিজয়ীদের তারকা হিসাবে দেখে; তাদের এমন ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়, সব বিষয়েই যার মতামতের ওপর নির্ভর করা যায়। এটি তাদের (নোবেলজয়ী) মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেয়।”

২০০৮ সালে ৪৩ বছর বয়সে ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ এবং ২০২০ সালে ৫৫ বছর বয়সে পদার্থে নোবেলজয়ী ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়া গেজ এ বিষয়ে একমত– ম্যাকআর্থার ফেলো হওয়া, আর নোবেল জেতা একেবারে ভিন্ন বিষয়।

তার মতে, নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে বিশাল দায়িত্ববোধের বিষয়টি জড়িত, কেননা নোবেলজয়ীকে বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই একজন নেতা হিসেবে দেখা হয়।

৪৩ বছর বয়সে ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ পাওয়ার পর ৫৫ বছর বয়সে পদার্থে নোবেল জয় করেন আন্দ্রেয়া গেজ।

নিজের উদাহরণ দিয়ে এই মহাকাশ বিজ্ঞানী বলেন, তার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার জায়গাটি ছিল নারীদের ইতিবাচক প্রতিনিধি হওয়া এবং বিজ্ঞানের গুরুত্ব রক্ষা করা– আর এগুলো এমন ধরনের প্রভাব যা প্রকাশনা বা উদ্ধৃতিতে আসে না।

এদিকে নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক দাসুন ওয়াংয়ের মতে, নোবেলজয়ীরা মনে করেন, তারা একটি গবেষণায় চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন, তাই তারা নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন, যা তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।

ড. ইয়োএনিডিস অবশ্য শুধু প্রকাশনা বা উদ্ধৃতির ভিত্তিতে একজন বিজ্ঞানীর উৎপাদনশীলতা পরিমাপে সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন।

তিনি এটাও মানেন যে, এগুলো গল্পের কেবল একটি দিকই তুলে ধরে। তার মতে, “বিজ্ঞান ও সমাজে পদচিহ্ন রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক বিষয় রয়েছে।”

তথ্যসূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত