Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের এক বছর

গাজার বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সবকিছু প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
গাজার বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সবকিছু প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
[publishpress_authors_box]

ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের ওপর ইসরায়েলি জেনোসাইড বা জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞের এক বছর পূর্ণ হলো সোমবার।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে পড়ে এক নজিরবিহীন হামলা চালায়।

ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সেদিন থেকেই গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তার কয়েক সপ্তাহ পরে স্থল আগ্রাসনও চালায়। সেই থেকেই গাজায় চলছে এক দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞ।

হামাসের ওই হামলা ছিল গাজা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত অভিযান। এতে ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয় এবং জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় ২৫০ জনকে।

ইসরায়েলের ওপর এমন হামলা আর কখনও হয়নি। ইসরায়েল এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করে হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফিলিস্তিনিদের ‘অর্ধমানব’ আখ্যায়িত করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, ইসরায়েলের চলমান হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরে গত ১২ মাসে ৪২ হাজার ৬১২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখের বেশি মানুষ এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১০ হাজার জন।

এর মধ্যে গাজায় নিহত হয়েছেন ৪১ হাজার ৮৭০ জন। তার মধ্যে ১৬ হাজার ৭৬৫ জনই শিশু এবং ১০ হাজারের বেশি নারী। এ ছাড়া গাজায় আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ এবং ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে নিখোঁজ রয়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ।

পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন ৭৪২ জন, যার মধ্যে শিশু ১৬৩ জন। আর আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৫০ জন।

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ধ্বংস হয়েছে ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক ভবন ও স্থাপনা।

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় শুধু মানুষই মরেনি, পুরো অবকাঠামোও ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সবকিছু প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। এককথায় গাজাবাসীদের ওপর পূর্ণমাত্রার একটি জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।

৬ অক্টোবর পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ফিলিস্তিনি সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজার অর্ধেকের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৮০ শতাংশ বাণিজ্যিক ভবন ও স্থাপনা। মাটিতে মিশে গেছে ৮৭ শতাংশ স্কুল ভবন।

৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১৭টি আংশিকভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে পারছে। সড়ক পথের ৬৮ শতাংশ এবং ফসলি জমির ৬৮ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৭ লাখ ১৮৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৫৬টি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভবন পুরোপুরি ধ্বংস বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ৫২৯ জন শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মচারীসহ ১০ হাজার ৮৮৮ জনেরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৭ হাজার শিক্ষার্থী এবং ৩ হাজার ৬৮৬ জন শিক্ষক।

পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরের শিশুরাও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিসেফ বলেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও চলাচলের বিধিনিষেধের কারণে সেখানেও প্রায় ৭ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় অতিরিক্ত বাধা তৈরি হয়েছে। পশ্চিম তীরের প্রায় ২০ শতাংশ স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।

এবছর ৬ বছর বয়সী ৪৫ হাজার শিশু তাদের শিক্ষাজীবনের প্রথম বছর বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। আর প্রায় ৬ লাখ ২৫ হাজার শিশু গত এক বছর ধরে বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি।

গাজায় প্রায় ৮৭ হাজার ভবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।

আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর একটি বিবৃতি অনুযায়ী, হাউজিং, ল্যান্ড অ্যান্ড প্রপার্টি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ সেপ্টেম্বরে রিপোর্ট করেছে, গাজায় কমপক্ষে ২ লাখ ৯৭ হাজার আবাসিক ইউনিট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ হাজার ভবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।

গাজার যে পরিমাণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে তার আর্থিক মূল্য আনুমানিক প্রায় ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ আবাসন খাতের, ১৯ শতাংশ পানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সরকারি পরিষেবার অবকাঠামো এবং ৯ শতাংশ বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবনের ক্ষতির মূল্য।

জাতিসংঘের মতে, গাজা ভূখণ্ডে অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে বহু মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গাজার মোট বাসিন্দা প্রায় ২৩ লাখ।

প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

গাজায় ইসরায়েলের অনবরত বোমা বর্ষণে মানুষ ও অবকাঠামোর পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণ ও প্রকৃতির ওপরও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। ইউরোপীয় আইন ইনস্টিটিউট পরিবেশের ওপর এমন ধ্বংসযজ্ঞের নাম দিয়েছে ‘ইকোসাইড’।

১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক আর্থার গ্যালস্টন এই ধারণাটির প্রবর্তন করেন। তিনি শত্রু দেশের গাছপালা এবং ফসল ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ভেষজনাশক এবং ডিফোলিয়েন্ট এজেন্ট অরেঞ্জ ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছিলেন।

সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা নেটওয়ার্কে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলার ফলে ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছে।

যুদ্ধের প্রথম ১২০দিনে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন হয়েছে তা ২৬টি দেশ ও অঞ্চলের বার্ষিক কার্বন নির্গমনের চেয়ে বেশি ছিল। আর এর ৯০ শতাংশের জন্যই ইসরায়েল দায়ী।

দ্য গার্ডিয়ান গত জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে, জাতিসংঘের এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, গাজা থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করতে ১০০টিরও বেশি লরির ১৫ বছর সময় লাগবে। আর এতে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ৬০ কোটি ডলার।

জাতিসংঘের মূল্যায়নে আরও দেখা গেছে যে, গাজার অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ ফেলার জন্য জায়গা লাগবে ২৫০ থেকে ৫০০ হেক্টর (৬১৮ থেকে ১২৩৫ একর)।

জাতিসংঘের এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইসরায়েল গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে ৫১৬টি এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৬১৯টি হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলি হামলায় মোট ৭৬৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত, ১১০টি ভবন ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেইসাথে ৩২টি হাসপাতাল এবং ১১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পূর্ব জেরুজালেম ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত এবং ১১১ জন আহত হয়েছে। ৪৪৪টি অ্যাম্বুলেন্স ও ৫৬টি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংস্কৃতির ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

গাজায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত স্থাপনাকে লক্ষ্য করেও হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইউনেস্কোর হিসাব মতে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৬৯টি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ধর্মীয় স্থান, ৪৩টি ঐতিহাসিক এবং/অথবা শৈল্পিক তাৎপর্যপূর্ণ ভবন, দুটি অস্থাবর সাংস্কৃতিক সম্পত্তির আমানত, ছয়টি স্মৃতিস্তম্ভ, একটি জাদুঘর এবং সাতটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

নিরাপদ কোনও জায়গা নেই

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত বছরের ১ ডিসেম্বর গাজা উপত্যকার একটি অনলাইন মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে গাজার ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ৬০০টিরও বেশি ব্লকে বিভক্ত করা হয়। গাজার বেসামরিক নাগরিকদের তাদের বসবাসের এলাকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্লকটি চিহ্নিত করতে এবং নির্দেশ দেওয়া হলে সরে যেতে বলা হয়েছে।

তবে সরে যাওয়ার আদেশ দেওয়া লিফলেটগুলো অনলাইন সতর্কতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, যা গাজার বাসিন্দাদের বিভ্রান্ত করেছে।

আর গাজার বেশিরভাগ বাসিন্দার মানচিত্রটি দেখার কোনও সুযোগও নেই। ইসরায়েলের অবরোধ ও হামলার ফলে গাজার টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। গাজার খুব কম মানুষই বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সুবিধা পায়।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, আনাদুলু নিউজ এজেন্সি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত