গ্যালারিতে উড়ছে আকাশী নীল পতাকা। সমর্থকদের চীৎকারে কান পাতা দায় স্টেডিয়ামে। মাঠের মধ্যে ট্রফি নিয়ে উল্লাস করছে আবাহনীর ফুটবলার, কর্মকর্তারা। এমন উদযাপন যেন ভুলতেই বসেছে আবাহনী।
অথচ ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে সফল দল আবাহনী, জিতেছে সবচেয়ে বেশি ছয়বার পেশাদার লিগ শিরোপা। সেই দলটারই কি করুণ অবস্থা? যেন ধীরে ধীরে ঐতিহ্যের কঙ্কালে পরিণত হতে যাচ্ছে আবাহনী।
বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেই নেতিয়ে যাচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী দলটি। ঠিক যখন থেকে দেশের ফুটবলে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বসুন্ধরা কিংসের আগমন, তখন থেকেই বলতে গেলে পতনের শুরু আবাহনীর। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে আবাহনী ৩-০ গোলে বসুন্ধরা কিংসের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে টুর্নামেন্ট থেকে। এবারের মৌসুমে খালি হাতেই থাকতে হচ্ছে আবাহনীকে। গত মৌসুমেও ছিল একই দুরবস্থা।
গত কয়েক মৌসুমে বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে পারফরম্যান্সের পরিসংখ্যান তুলনা করলে একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে, শুধু পিছিয়েই পড়ছে আবাহনী। ২০১৮-১৯ মৌসুমে প্রথমবার প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে এসেই চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস। পরের মৌসুম করোনার কারণে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এরপর থেকে টানা ৪ বার লিগ শিরোপা জিতল বসুন্ধরা কিংস।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ৫ মৌসুম আগে নতুন দল হিসেবে আসা বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে ৫টি লিগ খেলার পরেও প্রিমিয়ার লিগে বসুন্ধরার বিপক্ষে কোনও জয় নেই আবাহনীর।
জিতবে কি করে? বসুন্ধরা কিংসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো দলই যে গড়তে পারে না আবাহনী! বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে আবাহনী শেষ জয় পেয়েছে ৮৭৯ দিন আগে। যেটি ছিলো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা কাপ ফাইনালে।
বসুন্ধরা কিংস ও ঢাকা আবাহনী অংশ নিয়েছে এমন প্রতিযোগিতায় আবাহনী জিতেছে দু’বার। অন্যদিকে বসুন্ধরা জিতেছে ১০বার ( এর মধ্যে ৫টা লিগ শিরোপা)।
বসুন্ধরা কিংস প্রিমিয়ার লিগে আসার পর লিগ শিরোপার মুখ দেখেনি আবাহনী। এর মধ্যে এক মৌসুমে দু’দলের সর্বোচ্চ ১৮ পয়েন্টের ব্যবধান ছিলো। এবারের মৌসুমে ১৫ তম রাউন্ড শেষে এই ব্যবধান ছিল ১৪ পয়েন্টের।
আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও দুরবস্থা আবাহনীর। ২০১৯ সালের পর সরাসরি এএফসি টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্যায়ে উঠতে পারেনি দলটি।
এ পর্যন্ত বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে ১৫ মুখোমুখিতে আবাহনী জিতেছে মাত্র ২ বার। অপরদিকে বসুন্ধরার জয় ১১টি। দুবার হয়েছে ড্র।
এছাড়া মাঠের বাইরে আবাহনীর সেরা ফুটবলারদের প্রতি মৌসুমে দলে ভেড়াচ্ছে বসুন্ধরা কিংস। রাকিব হোসেন, দরিয়েলতন গোমেজ আবাহনী থেকে বসুন্ধরা কিংসে গিয়ে নিজেদের নিয়ে তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়।
আবাহনী সাইন করায় বসুন্ধরায় বেঞ্চে বসে থাকা প্লেয়ারদের। ট্রান্সফার মার্কেটে বসুন্ধরার সঙ্গে কখনও টেক্কা দিতে পারেনি এখন পর্যন্ত। জাতীয় দলেও স্বাভাবিকভাবে আবাহনীর চেয়ে বসুন্ধরা কিংসের ফুটবলাররা সুযোগ পাচ্ছে বেশি।
আবাহনীর ঐতিহ্য বসুন্ধরা কিংসের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। কিংসের মুখোমুখি হলেই বেরিয়ে আসে তার কঙ্কালসার চেহারা।
একটা সময় আবাহনীর জার্সিতে মাঠ মাতিয়েছেন আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু। আবাহনীর দুরবস্থা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এই ফুটবলারের, ‘আমি নিজেকে সবসময় আবাহনীর চুন্নু হিসেবে পরিচয় দিই। এতে আমি গর্ববোধ করবো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই করবো। তবে দলটাকে যখন মাঠে বারবার হোচট খেতে দেখি, হৃদয় ভেঙে যায়। দায়িত্বে অবহেলা ও আন্তরিকতার অভাবের কারণে একটি কর্পোরেট ক্লাবের কাছে বারবার ধরাশায়ী হতে হচ্ছে আমাদের।’
ক্লাবটির বর্তমান ম্যানেজার নজরুল ইসলামও হতাশ আবাহনীর বর্তমান অবস্থা দেখে, “আসলে কি বলবো? সব দলেরই বাজে সময় যায়। আমাদের দলেরও খারাপ সময় যাচ্ছে। তবে আগামী মৌসুমে ঘুরে দাড়াবো আমরা। আবাহনী সব সময় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই দল গড়ে। কিন্তু এই মৌসুমে আমরা লিগ, টুর্নামেন্ট কোথাও ভালো করতে পারিনি।”
দলের বিদেশি ফুটবলারদের মান ততটা ভালো ছিল না বলে মনে হয়েছে তার, “ বড় ম্যাচে বিদেশি খেলোয়াড়েরা জ্বলে উঠতে পারছে না। ওদের (বসুন্ধরার) বিদেশিরা কেমন খেলছে, আর আমাদেরগুলো দেখুন। পার্থক্য তো মাঠেই পরিস্কার।’
যে দলের ফুটবলাররা কোনও ম্যাচ হারা দূরে থাক, ড্র করলেই এক সময় স্টেডিয়াম থেকে বের হতে ভয় পেত। গ্যালারি থেকে উড়ে আসতো সমর্থকদের গালাগালি, ইটের টুকরো এসে পড়তো টিম বাসে। সেই আবাহনী দিনের পর দিন লিগ শিরোপা জিততে পারছে না। এবার তো যার-তার সঙ্গেই হেরেছে। আকাশী নীল নয়, একটু একটু করে যেন বেদনার রঙে নীল হয়ে যাচ্ছে আবাহনী।