কিছুদিন বাদেই মাঠে গড়াচ্ছে ঘরোয়া ফুটবল। অস্থিরতার দলবদলে এবার অংশ নেয়নি দেশের দুটি বড় ক্লাব- শেখ জামাল ধানমন্ডি ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র। যারা অংশ নিচ্ছে, সেই দলগুলোও ভালোভাবে ঘর গোছাতে পারেনি। নতুন মৌসুমে তাদের প্রস্তুতি কেমন, শিরোপার অঙ্কে কারা এগিয়ে- সেটাই উঠে এসেছে সকাল সন্ধ্যার ৫ পর্বের ধারাবাহিক আয়োজনে। আজ (বৃহস্পতিবার) থাকছে প্রথম পর্ব-
- বিদেশি ছাড়া খেলবে আবাহনী
- ঢাকা লিগে ১১ ও প্রিমিয়ার লিগে ৬ শিরোপা তাদের
- প্রথমবার শিরোপার স্বপ্নহীন আকাশি-নীল
‘আমরা সব সময় চ্যাম্পিয়নের জন্যই দল গড়ি’- দল বদলের দিনে এই আপ্তবাক্যটা আবাহনী কর্মকর্তাদের মুখে বরাবরই শোনা যেত। কিন্তু সেই আবাহনীই কিনা এবার দল গড়েছে কোনও রকমে। সেই চ্যাম্পিয়নের স্বপ্ন এবার নেমে এসেছে কোনোরকমে টিকে থাকার লড়াইয়ে।
শীর্ষ স্তরের ফুটবলারদের অনেকে হন্যে হয়ে একটা দলে কোনোমতে নাম লিখিয়েছেন। অনেকে তো ‘পেটেভাতে’খেলতে রাজি হয়েছেন। অনেকের পারিশ্রমিক নেমে এসেছে ৫-৭ লাখ টাকায়। অনেককে খেলতে হবে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বেতনে। বাস্তবতা হচ্ছে- শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনীর এমন বাজে সময় খুব কমই এসেছে।
নতুন মৌসুমের দল বদলে বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করলেও সরকার পরির্বতনের পর তা বাতিল করা হয়েছে। বিদেশি কোচও এবার আবাহনীর ডাগ আউটে দেখা যাবে না। ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কোচ মারুফুল হকের হাতে দেওয়া হতে পারে আকাশী নীলদের দায়িত্ব।
বিদেশি ছাড়াই আবাহনী
স্বাধীনতার পর এমন দুঃসময় খুব কমই পার করেছে আবাহনী। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবাহনী ক্লাবে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর করা হয় ক্লাব ভবনে, লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় ৫২ বছরের অর্জিত সাফল্যের সব ট্রফি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে দল হিসেবে আবাহনীর মাঠে থাকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ফুটবলের চলতি দলবদলে অংশ নিয়েছে ঠিকই আবাহনী। কিন্তু চেনা চেহারায় পাওয়া যাবে না তাদের। কারণ ক্ষমতার পালাবদলে বেশিরভাগ পরিচালকই পালিয়ে গেছেন, কয়েকজন আছেন কারাগারে।
তাই আগের মতো অর্থের জোর নেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির। ফুটবলের অন্যতম সফল ক্লাবটি এই মৌসুমে কোনও বিদেশি ফুটবলার নিচ্ছে না। যদিও বেশ কয়েকজন বিদেশি খেলোয়াড়ের সঙ্গে আগে কথা সেরে রেখেছিল তারা।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করা আর সম্ভব হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন দলটির ম্যনেজার নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা এবার কোনও বিদেশি খেলোয়াড় নিচ্ছি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই ক্লাবের ঊর্ধ্বতনদের সিদ্ধান্ত। বিদেশি কোচও আমরা আনছি না।”
যদিও বিদেশিদের ছাড়া খেলতে মুখিয়ে আছেন স্থানীয়রা। ফরোয়ার্ড জাফর ইকবাল যেমন সুযোগটাকে নিজেদের মেলে ধরার মঞ্চ হিসেবেই দেখছেন, “বড় দলগুলো সব সময় বিদেশি নির্ভর দল গড়ে। কিন্তু এবার যেহেতু আবাহনী বিদেশিদের ছাড়া দল গড়েছে, আমাদের জন্য এটা বড় সুযোগ। অন্তত ৫ জন দেশি ফুটবলার ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। আমরা এই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে চাই।”
কেমন হয়েছে আবাহনী দল
গোল পোস্টের নিচে দীর্ঘদিনের চেনা মুখ শহীদুল আলম সোহেলকে এবার দেখা যাবে না। ১৫ বছরের সম্পর্কের শেষ করেছেন চট্টগ্রামের এই ফুটবলার। নাম লিখিয়েছেন রহমতগঞ্জে। তবে এবার মাহফুজ হাসান প্রীতম, শামীম হোসেন, আরিফুজ্জামান হিমেল ও মিতুল মারমাকে দলে নিয়েছে আবাহনী।
রক্ষণভাগে আছেন শাহিন আহমেদ, হাসান মুরাদ, ইয়াসিন খান, শাকিল হোসেন, ইয়াসিন আরাফাত, কামরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান বাবলু, সবুজ হোসেন, শাকির আহমেদ।
আবাহনীর মাঝমাঠ সামলাবেন রবিউল ইসলাম, মোহাম্মদ হৃদয়, মাহাদী ইউসুফ খান, আসাদুল মোল্লা, ফয়জুল্লাহ, আরাফাত হোসেন তাসিন, তন্ময় দাস।
তরুণ ও অভিজ্ঞতার মিশেলের ফরোয়ার্ড লাইনে দেখা যাবে শাহরিয়ার ইমন, জাফর ইকবাল, আরমান ফয়সাল আকাশ, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সারোয়ার জামান নিপু, মিরাজ প্রধান, এনামুল ইসলাম গাজী, মিরাজুল ইসলাম, আলামিন হোসেন আনাফ, আমিনুর রহমান সজীব।
সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক কার
ক্ষমতার পালাবদলের আগেই অনেক ফুটবলার আবাহনীর হয়ে খেলার জন্য নিবন্ধন করে ফেলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় চাইলেও তাদের কেউ অন্য কোনও ক্লাবে যেতে পারছেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এই ক্লাবে খেলতে হচ্ছে। কিন্তু আগে যে পারিশ্রমিকে খেলতে সম্মত হয়েছিলেন, ক্লাব কর্তৃপক্ষ সেই টাকাও দিতে পারবে না ওই ফুটবলারদের।
অনেকেই তাই ফুটবল ক্যারিয়ার বাঁচাতে এক অর্থে ক্লাবের সঙ্গে ‘আপস’ করতে বাধ্য হয়েছেন।
যদিও এ মুহূর্তে পারিশ্রমিক নিয়ে কোনও ফুটবলার বা কর্মকর্তাদের কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। কিন্তু ক্লাবের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর, মোহাম্মদ হৃদয় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৪০ লাখ টাকায় নাম লিখিয়েছেন আবাহনীতে। প্রশ্ন হলো, এখনকার ছন্নছাড়া আকাশী-নীল শিবিরে এত জোর অবশিষ্ট আছে!
গৌরবের ট্রফি
ফুটবলে আবাহনীর রয়েছে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে জিতেছে অসংখ্য ট্রফি। ১৯৭৩ সালে ঢাকা লিগ দিয়ে শুরু হয় আকাশী নীল দলের যাত্রা। প্রথমবার অংশ নিয়েই রানার্সআপ হয়ে সবাইকে চমকে দেয় আবাহনী। শিরোপার দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ফুটবল ক্লাব আবাহনী ১৯৭৪ সালে নিজেদের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলে। সেই শুরু এরপর ঢাকা লিগে মোট ১১ বার শিরোপা জিতেছে আবাহনী। ২০১১ সালে জেতে কোটি টাকার সুপার কাপ।
২০০৭ সালে শুরু পেশাদার ফুটবল লিগ। প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। সব মিলিয়ে ২০০৭, ২০০৮-০৯,২০০৯-১০,২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ছয়বার পেশাদার লিগ শিরোপা জিতেছে। এছাড়াও ফেডারেশন কাপ জিতেছে ১১ বার। ১৯৮২ সালে প্রথমবার ফেডারেশন কাপের শিরোপাা জেতে।
আর্ন্তজাতিক পর্যায়েও সফল আবাহনী। ভারতে ৩টি টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে নাগজি ট্রফি দিয়ে শুরু। ১৯৯৪ সালে চার্মস কাপ (ভারত) এবং ২০১০ সালে বরদুলই কাপ জিতেছে।
এছাড়া ১৯৯১ সালে দুই বাংলার সেরা ৬টি দল নিয়ে একটি টুর্নামেন্ট হয়েছিল যাতে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। এটাকে ছাড়িয়ে গেছে তাদের এএফসি কাপের সাফল্য। ২০১৯ সালে এএফসি কাপের আন্তঃআঞ্চলিক সেমিফাইনালে খেলেছে আবাহনী। এই গৌরব নেই অন্য কোনও দেশি ক্লাবের।
শেষ কথা
দলবদল শেষ। ফুটবল মাঠে গড়ালেও এই মৌসুমে স্বাধীনতা কাপ হচ্ছে না। ফেডারেশন কাপ, লিগ আর আর একটা মাত্র ম্যাচের চ্যালেঞ্জ কাপ হবে। এসব আয়োজনে বসুন্ধরা কিংস ও মোহামেডানই হয়তো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবে।
কিংসের বড় প্রতিপক্ষ হতে পারে মোহামেডান। কিন্তু বিদেশী ছাড়া আবাহনী এবার নখদন্তহীন। এটা শুনে ক্লাবটির সাবেক তারকা আশরাফউদ্দিন চুন্নু চরম ক্ষুব্ধ, ‘এটা লজ্জাজনক। এসব শুনে আমার কষ্ট লেগেছে বেশি। স্বাধীনতার পর আবাহনীর ইতিহাসে এমনটা হয়নি কখনও। বিদেশি ছাড়া খেলবে আবাহনী ভাবতেও পারিনা এটা। আবাহনী দল গড়তে টাকা নেই, এটা নাকি বলা হচ্ছে। তাহলে এত দিনের ক্লাবের সুবিধাভোগীরা কোথায় গেল? আসলে ওরা সুসময়ের পাখি ছিল। ওরা উড়ে গেছে।”
তারপরও আবাহনীকে চ্যাম্পিয়ন লড়াইয়ে দেখতে চান জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার, “বিদেশিরাই সাধারণত পার্থক্যটা গড়ে দেয় আবাহনীর। কিন্তু যেহেতু সেটা এবার হচ্ছে না তাই স্থানীয়দেরই উজাড় করে খেলতে হবে। আবাহনীর সম্মান ধরে রাখার দায়িত্ব এবার তাদের হাতেই।”