যে ঘটনার জের ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন তা আরও দেড় বছর আগে মীমাংসিত। এমনটাই দাবি করেছেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ‘‘এ ঘটনা দেড় বছর আগে মীমাংসিত হয়ে গেছে।’’
তিনি যুক্ত করেন, “আল্লাহর কি খেলা! ও মারা যাওয়ার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আমার নাম জড়িয়ে দিয়েছে। আমি শিক্ষক, আমার কাজ ছাত্র- ছাত্রীদের সেবা দেওয়া “
বিষয়টা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি দোষী হলে দোষ মাথা পেতে নিব। আর নির্দোষ হলে বেরিয়ে যাব।’’
গত শুক্রবার রাতে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা।
নিজের ফেইসবুক পাতায় দেওয়া ওই পোস্টে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে বাজে আচরণের অভিযোগ করেন তিনি।
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার করে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া রায়হানকে সহায়তার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত ও সহকারী প্রক্টর পদ থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ঘটনা তদন্তে জবি শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এর মধ্যে জানা গেছে দ্বীন ইসলাম এর আগে একবার কারাগারে ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে জেলে গিয়েছিলেন কি না, এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে ছাত্র বিক্ষোভ হয় তখন আমি জেলে গিয়েছিলাম। সে সময় ৫ মাস ২২ দিন কারাগারে ছিলাম। সেখান থেকেই আমি তখন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি।’’
অভিযুক্ত দ্বীন ইসলামের বিবৃতি
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলাম একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ঘটনা প্রায় দেড় বছর আগের। অবন্তিকার ব্যাচমেটরা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে। সেখানে অবন্তিকাও উপস্থিত ছিল। জিডিতে উল্লেখ করা হয় যে, কেউ একজন ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে তাদেরকে হয়রানি করে।
পুলিশ তখন উচ্চতর তদন্তের আশ্বাস দিয়ে বলে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আইডিটা কে চালায় সেটা বের করে দেব। এই কথা শুনে অবন্তিকা থানা থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে আসার পথেই তার বন্ধুদের কাছে স্বীকার করে যে, আইডিগুলো সে নিজেই চালায়। তখন তার বন্ধুরা প্রক্টর অফিসে নিয়ে এসে অবন্তিকার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট একটা লিখিত অভিযোগ দেয়।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় অবন্তিকার মাকে ডাকা হয়। সব জেনে তিনি এবারের মতো বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানান। অভিযোগকারীরা তখন বলে, আমরা তাকে আগামী ৩ মাস পর্যবেক্ষণ করব এবং যদি সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তাহলে আমরা ৩ মাস পরে জিডিটা তুলে নেব। ঝামেলা এখানেই প্রাথমিকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়।
মৃত্যুর আগে অবন্তিকার স্ট্যাটাসের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আম্মানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ঘটনা নিষ্পত্তি হয় ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট। এরপর এই বিষয় নিয়ে আর কারও সঙ্গে কোন আলোচনা হয়নি কখনও।
প্রক্টর অফিসে অবন্তিকা এবং তার মাকে একবারই ডাকা হয়েছিল। একাধিকবার ডেকে হেনস্তা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। কারণ বিষয়টি ওইদিনই মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
সুইসাইড নোটে উল্লেখ করা অবন্তিকাকে বহিষ্কার করার বিষয়ে তিনি জানান, “এ বিষয়ে আমি কখনও কিছুই বলিনি। কারণ বিষয়টি মিমাংসা হওয়ার পরে গত দেড় বছরে একবারও তার বা তার পরিবারের সঙ্গে আমার কোনও কথা বা যোগাযোগ হয়নি।”
ছেলেসহ আত্মহত্যার হুমকি অবন্তিকার মায়ের
এদিকে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না পেলে ছেলেসহ আত্মহত্যা করার হুমকি দিয়েছেন অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম। কুমিল্লায় নিজ বাসায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অবন্তিকাকে যারা যারা মানসিক নিপীড়ন করেছে তারা সবাই দায়ী।
তিনি বলেন, “আমি নিজে সুইসাইড করে ফেললেও কিছু নাই। আমি জগতের কাছে বিচার দিয়ে যাবো। আমি আমার ছেলেটাকে নিয়ে শেষ হয়ে যাব। আমার মেয়ের কী অপরাধ ছিল? আমার মেয়ে ভালো স্টুডেন্ট এটাই কি তার অপরাধ? আমার মেয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিল, এটাই তার অপরাধ?”
যারা মানসিক নিপীড়ন করেছে তাদেরকে দায়ী করে অবন্তিকার মা বলেন, “ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, প্রক্টর, সবাইকে জানিয়েছি, কী ব্যবস্থা নিয়েছে তারা? রাফি নামের একটা ছেলে স্ট্যাটাস দিল, হাত পা গুড়াইয়া শেষ করে দিব। তারপর আমি দ্বীন ইসলাম নামে এক শিক্ষককে জানিয়েছি। বলেছি, ও আমার মেয়েকে বিরক্ত করে। ওদের কিছু বলেন না। বললেন, ওরা তো আইনের ছাত্র, ওরা আমাকে ফাঁসিয়ে দিবে।”
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তা না হলে উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করার হুমকি দিয়েছে তারা।
শনিবার দুপুর ৩টার পর পর অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এসময় ছয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ সংলগ্ন ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষীবাজার ও রায়সাহেব বাজার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে।
ছয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। আম্মানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং দ্বীন ইসলামকেও অবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনতে হবে। অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে। ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করে ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে। নারী নিপীড়ন সেল কার্যকর করতে হবে।
আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যে দাবি পূরণ না হলে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা।