বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার সংস্থাটির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীসহ সাত আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মঙ্গলবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা সাত আসামিকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন।
ঢাকার আলাদা সাত সিএমএম আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করে। এরপর আদালতের নির্দেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ১২ বছরে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার রবি ও সোমার আলাদা অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় ১৭ জনকে। এদের মধ্যে সাতজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেন।
এরা হলেন, পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলাম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, তার ভাই সাখাওয়াত হোসেন, ব্যবসায়ী সায়েম হোসেন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার।
বাকি আসামিদের পক্ষে মঙ্গলবার জামিন আবেদন করা হয়েছিল, পুলিশও রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছিল। তবে শুনানি শেষে এর কোনোটিই মঞ্জুর হয়নি। আদেশ অনুযায়ী ১০ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এরা হলেন, আবেদ আলীর ছেলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশিদ, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী মো. শাহাদত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুল হাসান ও জাহিদুল ইসলাম।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সোমবার রাতে ঢাকার পল্টন থানায় মামলা করে সিআইডি। এতে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষকে। যার মধ্যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানিয়েছেন, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ও মামলার পলাতক আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।
তদন্তে যা পেয়েছে সিআইডি
প্রশ্ন ফাঁসের তদন্তে নেমে প্রাথমিকভাবে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এখন সেসব তথ্য যাচাই চলছে। এরই মধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম বলেছেন। তাদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছে সিআইডি।
আজাদ রহমান জানান, আসামিরা বিসিএস পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের দায় স্বীকার করেছেন। এর ভিত্তিতেই মামলা করা হয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আসামিরা গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। সেসব বিষয়ে আলাদা মামলা ও তদন্ত হবে। আপাতত প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।”
সিআইডি কর্মকর্তা বলছেন, প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী এ চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক। তার অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত তদন্তে ঢাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ির সন্ধান মিলেছে। আবেদের গ্রামের বাড়িতে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ভবন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই আবেদ আলী এসব বিষয় স্বীকার করেছেন।
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে বিপুল অর্থ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। নিজে কত টাকা নিয়েছেন, অন্যদের কত দিয়েছেন, সে বিষয়েও তথ্য দিয়েছেন আবেদ আলী। সেসব তথ্যও যাচাই বাছাই করছে সিআইডি।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান আরও জানান, মিরপুর শেওড়াপাড়ার বিসমিল্লাহ টাওয়ার নামের যে নয়তলা ভবন থেকে আবেদ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয় সেখানে তার মোট পাঁচটি ফ্ল্যাট ছিল। কয়েক মাস আগে দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন তিনি। পাইকপাড়া এলাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি থাকার কথাও স্বীকার করেছেন আবেদ।
পিএসসিতে আবেদ আলী ভুল ঠিকানা দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছিলেন। তার বাড়ি মাদারীপুর হলেও তিনি সিরাজগঞ্জের ঠিকানা দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৪ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাইভারের চাকরি হারিয়ে তখন তিনি প্রশ্ন ফাঁসের কারবারে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এরইমধ্যে ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়াম ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করেন, তাকেও প্রশ্ন ফাঁসের কাজে যুক্ত করেন আবেদ আলী।