Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫

ঢাকায় গাড়িচালক আবেদ আলীর এলাকায় পরিচিতি ‘শিল্পপতি’

আবেদ আলী জীবন।
আবেদ আলী জীবন।
[publishpress_authors_box]

পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে আলোচিত সৈয়দ আবেদ আলী জীবন গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তার জীবনের নানা তথ্য। মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে আবেদ আলী এলাকায় অনেক দান-খয়রাত করতেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। তারা বলছেন, তারা জানতেনই তা আবেদ আলী একটা সময় পিএসসির গাড়িচালক ছিলেন। এলাকায় তিনি শিল্পপতি হিসেবেই বেশি পরিচিত। তবে তিনি কীভাবে এত টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন – সে বিষয়ে তাদের কিছুই জানা ছিল না।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বেতলা গ্রামের আব্দুর রহমান মীরের ছেলে আবেদ আলী। এক সময়ে তার বাবা-মা ভিক্ষা করতেন। আবেদ আলী ৮ বছর বয়সেই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা চলে যান। ঢাকায় দিনে কুলির কাজ আর রাতে ফুটপাথে ঘুমিয়ে কেটেছে তার সময়।

ঢাকায় আসার পর গাড়ি চালানো শিখে চাকরি নেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। এখন জানা যাচ্ছে, পিএসসিতে চাকরির সুবাদে তিনি জড়িয়ে পড়েন প্রশ্নফাঁস চক্রে। অর্জন করেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। বাড়তে থাকে ক্ষমতাও। একটা সময় স্বপ্ন দেখেন ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। এজন্য এক-দেড় বছর ধরে প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছেন তিনি।

স্থানীয়রা বলছেন, আব্দুর রহমান মীরের তিন ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেজো। তার বড়ো ছেলে জবেদ আলী এখনও কৃষি কাজ করেন। ছোটো ছেলে সাবেদ আলী অটোরিকশা চালান। তাদেরই ভাই আবেদ আলী এলাকার মানুষের কাছে পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ব্যবহার করতেন দামি গাড়ি। আবেদ আলী নিজেও দামি গাড়িতে চড়তেন। এলাকার কেউ জানতেনই না তিনি পিএসসির গাড়িচালক ছিলেন। আবেদ আলী ঢাকায় রিয়েল স্টেট ব্যবসা করেন- এমন প্রচারই ছিল এলাকায়। কয়েক বছর ধরে এলাকায় ব্যাপক দানও করেছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার এক পর্যায়ে আব্দুর রহমান মীরের ছেলে আবেদ আলী জীবন তার নাম থেকে ‘মীর’ পদবি বাদ দেন। মীরের পরিবর্তে ‘সৈয়দ’ পদবি ব্যবহার করেন।

আবেদ আলী জীবনের উত্থানের কথা সম্প্রতি এক সমাবেশে তুলে ধরেন তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। তিনি বলেন, “আমার বাবা একদম ছোটো থেকে বড় হয়েছে। আমার বাবার বয়স যখন ৮ বছর তখন পেটের দায়ে ঢাকায় চলে গেছে। ঢাকায় গিয়ে কুলিগিরি করে ৫০ টাকা রুজি দিয়ে সে তার ব্যবসা শুরু করে। এখন সে এখন একটি লিমিটেড কোম্পানির মালিক। সে কষ্ট করে বড় হয়েছে।”

‘বিসিএস প্রিলি-লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে গত রবিবার একটি প্রতিবেদন প্রচার করে বেসরকারি টিভি চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। প্রতিবেদনে পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা লেনদেন এবং তাতে আবেদ আলীর জড়িত থাকার খবর প্রচার হওয়ার পর অভিযানে নামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সোমবার আবেদ আলী, তার ছেলে সিয়ামসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়।

মাদারীপুরের ডাসারের বাসিন্দা আবেদ আলী কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক বলে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। তাতে বলা হয়, আবেদ আলী ড্রাইভারের কাজ ছেড়ে এখন নিজেকে শিল্পপতি পরিচয় দেন। কয়েকটি কনস্ট্রাকশন ফার্মের প্রধান তিনি। রাজধানীতে তার রয়েছে দুটি বহুতল ভবন, মাদারীপুরে আছে আরেকটি বাড়ি। কুয়াকাটায় তিনি থ্রি-স্টার হোটেলও খুলেছেন।

এরপর আবেদ আলীকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়। তার বিপুল সম্পদের পাশাপাশি ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামের বিষয়েও নানা তথ্য আসে। যিনি পড়েছেন বিদেশে, ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা।

স্থানীয়রা বলছেন, আবেদ আলী জীবন বছর দেড়েক আগে গ্রামের বাড়ি এসে ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ার প্রচার শুরু করেন। কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ শুরু করেন আবেদ আলী ও তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সিয়াম। বাবা-ছেলে এলকায় দান খয়রাত করেন ‘দুই হাত ভরে’। আবেদ আলী গ্রামের বাড়িতে কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন; বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাস্তার পাশের সরকারি জায়গা দখল করে গরুর খামার করেছেন; করছেন মার্কেট। উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে ‘অনেক’ জমি কেনার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে আবেদ আলী গত কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে এলাকার ১০০ জনকে এক কেজি করে মাংস দেন। সেই ভিডিও শেয়ার করেন নিজের ফেইসবুকে পেইজে।

আবেদ আলীর ছেলে সিয়াম একাধিক দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। পড়েছেন ভারতের শিলং; পড়েছেন দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। তিনি একটা সময় হন ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। নিজেদের প্রভাব জাহির করার জন্য বড় বড় নেতার সঙ্গে ছবি তুলতেন বাবা-ছেলে দুইজনই। আর সেসব ছবি ফেইসবুকে বুস্ট করতেন।

আবেদ আলী নিজের ফেইসবুক পেজে একটি হোটেল নির্মাণ নিয়ে পোস্ট দেন গত ১৮ মে। পোস্টে তিনি লেখেন, “আমাদের নতুন হোটেল এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। হোটেল সান মেরিনা, কুয়াকাটা।”

এসব অভিযোগ বা তথ্যের বিষয়ে জানতে আবেদ আলী জীবন ও তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামের নম্বরে একাধিক বার ফোন দেওয়া হয় তারা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে। তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তাদের গ্রামের বাড়ি তালাবদ্ধ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আবেদ আলী পরিবারের সবাই ইউরোপের ভিসা করে রেখেছেন। যেকোনো সময় তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন।

আবদুর রবসহ স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, আবেদ আলী মীরের বাবা-মা এক সময় ভিক্ষা করতেন। এখন আবেদন আলীর অনেক অর্থবিত্ত হয়েছে। তিনি এলাকায় অনেক দান-খয়রাত করেন। কিন্তু কীভাবে এত টাকা-পয়সা তিনি করেছেন- সে বিষয়ে এলাকাবাসী কিছুই জানত।

“তবে এলাকার মানুষের জন্য আবেদ আলী অনেক কিছু করেন। বিপদে আপদে পাশে এসে দাঁড়ান। ঢাকায় সে কী করলো তা আমরা জানি না। এলাকায় সে ভালো লোক”, বলেন তাদের একজন।

ডাসার উপজেলা সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জলিল বেপারী বলেন, “আবেদ আলী তার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি ছাপিয়ে অন্যায় করেছে। কারণ ডাসারে এসে তাকে কোনও দিন আওয়ামী লীগ করতে দেখিনি। তার কর্মকাণ্ডে আমরা বিব্রত। আমি তার শাস্তি দাবি করছি।”

ডাসার প্রেসক্লাবের সভাপতি সৈয়দ রাকিবুল ইসলাম বলেন, “আবেদ আলী মীর ও তার ছেলে সিয়াম এক দেড় বছর ধরে এলাকায় উপজেলা নির্বাচনের কার্যক্রম করছে। এর আগে তারকে ওভাবে ডাসার উপজেলার মানুষ চিনত না। তবে তার নিজ গ্রাম পশ্চিম বোতলায় তিনি একটি তিনতলা ভবন, মসজিদ ও একটি গরুর ফার্ম করার পর আমাদের নজরে আসে।

”তখন তার বিরুদ্ধে সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে গরুর ফার্ম নির্মাণের অভিযোগ পাই। তা নিয়ে আমরা সংবাদপত্রে খবর পরিবেশন করি। এরপর উপজেলা প্রশাসন তা ভেঙ্গে দেয়। সারা দেশের প্রশ্ন ফাঁস করে তিনি ডাসারের বদনাম করেছেন। তাই আমরা তার শাস্তি দাবি করছি।”

আবেদ আলীর ছোট ভাই সফেদ আলী বলেন, “আমার ভাই ছোটো বেলা থেকেই অনেক কষ্ট করেছে। পরে ড্রাইভারের চাকরি পায়। ব্যবসা শুরু করার পর আর চাকরি করে নাই। সে যা করেছে ব্যবসা বাণিজ্য করেই করেছে। তার বিয়ের পর থেকে আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক নাই।”

আবেদ আলীকে নিয়ে যে আলোচনা চলছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোটেক মাসুদ পারভেজ বলেন, “যারা অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন করেছেন, তাদের নিয়ে সচেতন মহলের প্রশ্ন তোলা উচিত। সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রশ্ন ফাঁস করে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার কারণে তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।”

তার ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাদারীপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত