Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

তবুও আগ্রহে অভিজিৎ রায়

অভিজিৎ রায়কে স্মরণে গণজাগরণ মঞ্চ।
অভিজিৎ রায়কে স্মরণে গণজাগরণ মঞ্চ।
Picture of প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

“আমার নিজের প্রকাশিত বই, তাও আমাকে বিক্রি করতে হয় লুকিয়ে। কখন কী হয়ে যায়, তার তো কোনও ঠিক নেই,” সভয়ে বলছিলেন এক প্রকাশক।

কথা হচ্ছিল বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বই নিয়ে, আট বছর আগে যিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বইমেলার সামনে।

ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলার শিকার অভিজিৎ রায়ের ১০টি বই প্রকাশিত আছে। প্রকাশকদের যেমন ভয়, তেমনি সেই বই প্রকাশ্যে পড়ার ক্ষেত্রেও ভয় এখনও কাটেনি পাঠকদের।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে আক্রান্ত হন প্রবাসী অভিজিৎ এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

অভিজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন বন্যা। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁ হাতের আঙুল হারান।

তার কয়েক মাসের মধ্যে অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশকদের উপরও হামলা হয়। তাতে প্রাণ হারান জাগৃতী প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন। হামলায় আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল।

অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ে ২০২১ সালে পাঁচ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। দণ্ডিতদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক জিয়াসহ দুজন এখনও অধরা। আর বিচারিক আদালতে রায় হলেও মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।

অভিজিৎ রায়।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের নয় বছর এবং রায়ের পর তিন বছর গড়ালেও এখনও ভয় তাড়া করে বলে জানাচ্ছেন তার বইয়ের প্রকাশকরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রকাশক বলেন, “সেই রাতের কথা মনে করতে চাই না। আমি যখন শুনলাম, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কী করব, বুঝতে পারছিলাম না।

“অভিজিতের নামে আগে থেকেই অনেক থ্রেট আসত। কিন্তু ও গায়ে মাখত না। সাবধান থাকতে বললে ও শুধু হাসত।”

পদার্থবিদ অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ বাংলাদেশে বুয়েটে পড়াশোনার পর সেখানে শিক্ষকতাও শুরু করেছিলেন, পরে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থিতু হন। লেখালেখির জন্য জঙ্গিদের হুমকির মুখে থাকলেও বইমেলায় অংশ নিতে সেবার দেশে ফিরেছিলেন।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশকরাও আক্রান্ত হলে তার বই প্রকাশ নিয়ে সংকট তৈরি হয়। তার মধ্যেও কেউ কেউ সাহস নিয়ে প্রকাশ করেন বই।

ভয় নিয়েও কেন প্রকাশ করেন- প্রশ্নে এক প্রকাশক বলেন, “এগুলো তো জ্ঞানের বই। মানুষের পড়া উচিৎ। না পড়লে তো কেউ জানবে না। বছরে ১০টি বইও যদি বিক্রি হয়, তাতেও আমি খুশি । ১০ জন তো পড়ল, তারা জানবে।

“তারা বিভিন্ন জায়গায় এসব নিয়ে কথা বলবে। এভাবেই হয়ত আবার কোনও এক সময় মুক্তচিন্তার যেই দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠবে।”

অভিজিতের বই এখনও যারা পড়ছেন, তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলার সময় নাম প্রকাশ না করার বিষয়ে আশ্বস্ত করা হলে তিনি হেসে বলেন, “বোঝেন তাহলে অবস্থা। আপনাকে ভাবতে হচ্ছে আমার নিরাপত্তার কথা।”

অভিজিৎ রায়ের বই কতটা জরুরি, তা তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন, “অভিজিৎ রায়কে তো পড়তেই হবে। যেমন ধরেন, সমকামিতা ইস্যুতে সর্বোচ্চ আপনি ফেইসবুকে বা ব্লগে লেখা পাবেন, কিন্তু আপনার যদি এর ইতিহাস জানতে হয়, তাহলে তো বাংলায় অভিজিৎ রায়ের বই বাদে আর কারও বই নেই।”

নাস্তিকতার পক্ষে বললেও অভিজিৎ রায়ের যে ধর্মবিশ্বাসী কারও প্রতি অশ্রদ্ধা ছিল না, সে কথাও বলেন এই শিক্ষার্থী।

“এটা খুবই ইন্টারেস্টিং যে রিচার্ড ডকিন্স বা স্যাম হ্যারিসদের সাথে অভিজিৎ রায়ের একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। ধর্মবিশ্বাসী মানুষের প্রতি যে তার কোনও অসম্মান নেই, এমনকি ধর্মের প্রতিও যে তার অসম্মান নেই, এটা সে আগ বাড়িয়ে বলত।”

হত্যাকাণ্ডের পর অভিজিৎ রায়কে নিয়ে অনেক কথা হলেও তাকে লেখক হিসাবে তার মূল্যায়ন হচ্ছে না বলে এই পাঠকের আফসোস।

“তার প্রতি যে প্রকৃত সম্মান, তা কোনওদিন দেওয়া হয়নি। একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে সেই সম্মান তাকে দেওয়া হয় না।”

অভিজিৎ রায়কে স্মরণ।

প্রকৌশলী অভিজিৎ রায়ের লেখালেখির বিষয়বস্তু ছিল বিজ্ঞান। নানা কুসংস্কারের স্বরূপ উন্মোচন করতেন তিনি। মুক্তমনা নামে একটি ব্লগসাইটও খুলে নিজে লেখার পাশাপাশি অন্যদের লেখার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি।

এক সময় ব্লগে লিখতেন, কিন্তু অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর আর লেখেন না, এমন একজন বললেন, অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো পাওয়া এখন মুশকিলের হলেও এগুলো হারিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন না।

“যতটা সহজভাবে এসব পাওয়ার কথা ছিল, তা হয়ত পাওয়া যাচ্ছে না,কিন্তু যার প্রয়োজন হবে, জানতে ইচ্ছে করবে, সে তো খুঁজে নিয়েও পড়বে।”

“এখন ইন্টারনেট আছে, আপনি চাইলেই যা পড়তে চান, তা খুঁজে বের করতে পারবেন। যারা পড়ছে তারা নিজেরা নিজেরা আলোচনা কিন্তু করছে। এই সংখ্যা একদিন বাড়বেই। এখন হয়ত আমরা এই কথাগুলো বলতে পারছি না, কিন্তু সময় তো একদিন পাল্টাবেই।”

অভিজিৎ রায়ের লেখা এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক- এই প্রশ্নে তিনি বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্বের কথা তুলে বলেন, “আমরা দেশে বিজ্ঞান চর্চা মানে বুঝি ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হওয়া। আসল বিজ্ঞান চর্চা তো আমাদের দেশে হয় না। আমরা কিছু মিস্ত্রি তৈরি করছি, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তৈরি করতে পারছি না।”

এই প্রেক্ষাপটে অভিজিতের লেখা পড়ার গুরুত্ব তুলে সাবেক এই ব্লগার বলেন, “তার মতো এত সহজ ভাষায় এত কঠিন বিষয় কেউ লিখতে পারেনি।

“সে কারণে যে-ই এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইবে, তার জন্য অভিজিৎ রায়ের বইয়ের খুব একটা বিকল্প নেই।”

যেদিন অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছিল

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, জমজমাট বইমেলা থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক পার হতেই হামলার শিকার হন অভিজিৎ রায়।

সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের ভেতরেই ছিলেন আলোকচিত্র সাংবাদিক জীবন আহমেদ, তিনিই তাদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জীবন বলেন, হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার শোনেন তিনি। কাউকে জোরে আঘাত করলে যেমন চিৎকার করে মানুষ, তেমন। তা শুনে ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি।

“কাছে গিয়ে ভিড় ঠেলে দাঁড়াতেই দেখি মাটিতে একজন পড়ে আছে, আরেকজন মহিলা পাশে মোটরসাইকেলের উপর পড়ে আছে। চারদিকে রক্ত। পাশে থেকে মানুষজন বলছিল, চাপাতি দিয়া কোপাইছে।”

বিমূঢ়তা কাটিয়ে জীবন প্রথমে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নারীকে ডাক দেন। চেতন ফিরলে তিনি মুখ তুললে দেখা যায়, তার সারা মুখ রক্তাক্ত।

জীবন পরে জানতে পারেন, ওই নারী রাফিদা আহমেদ বন্যা। আর পাশের জন অভিজিৎ রায়।

এই স্থানেই খুন হয়েছিলেন অভিজিৎ রায়।

“চেতনা ফেরার পর বন্যা প্রথমে বুঝতে পারেননি কী হয়েছে। পরে তাকে জানানো হলে তিনি চিৎকার করে অভিজিতের দিকে ছুটে যান।”

তখন একটি অটোরিকশায় দুজনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রওনা হন জীবন।

“বন্যা সিএনজিতে ওঠার পরই সিটে হেলান দেওয়া অবস্থায় জ্ঞান হারান। তবে কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান ফিরে পান। তখন তিনি আর আমাকে চিনতে পারছিলেন না। আমাকেই হত্যাকারীদের সহযোগী ভাবছিলেন। খুব উচ্চস্বরে বলছিলেন, আপনি কে? এখানে কেন? কী চান?”

“উনি বলতে থাকলেন, ‘আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আমাদের কেন মারতেছেন?’ এরপরই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।”

ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর সেই রাতেই মারা যান অভিজিৎ। বন্যা চিকিৎসা নিয়ে সেরে ওঠার পর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান।

সেই রাতের বর্ণনা দেওয়া শেষ করে জীবন বলেন, “ওই রাতের কথা এখনও ভূলতে পারি না। আমি নিজেও মানসিকভাবে বেশ কিছুদিন সুস্থ ছিলাম না।”

অভিজিৎ রায়ের লেখালেখিতে বিভিন্ন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সহায়তা করতেন। তাদের কেউ কেউ মুক্তমনাতেও লিখতেন। অভিজিতের পর তারাও হন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দুই মাসের মাথায় সিলেটে হামলায় নিহত হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। ব্যাংকে চাকরির পাশাপাশি ‘যুক্তি’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি।

অভিজিতের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির প্রুফ দেখেছিলেন বিজয়। সেজন্য আলাদা করে এই বইয়ে অভিজিৎ ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তাকে।

এই বইটি প্রকাশের জন্য জাগৃতীর কর্ণধার দীপন এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধার টুটুলকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন অভিজিৎ।

জাগৃতী ও শুদ্ধস্বরের কর্ণধাররা ওই বছরের অক্টোবরে আক্রান্ত হন। জাগৃতীর মালিক দীপনকে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে তার কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

একই দিন একই সময় শুদ্ধস্বরের মালিক টুটুল লালমাটিয়ায় তার কার্যালয়ে আক্রান্ত হন। সেদিন তার সঙ্গে থাকা লেখক, ব্লগার রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিমের উপরও হামলা হয়। তারা জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান।

তখন ধারাবাহিকভাবে লেখক-ব্লগার-অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলা হয়েছিল। ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী সেই হামলাগুলো চালিয়েছিল বলে পরে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত