বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে নিহত আবু সাঈদ এখন দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার রংপুরের পীরগঞ্জে আবু সাঈদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তিনি একথা বলেন। প্রথমেই তিনি সাঈদের কবর জিয়ারত করেন, এরপর কথা বলেন সাঈদের পরিবারের সঙ্গে।
এই আন্দোলনের বড় বাক পরিবর্তন হয়েছিল আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবু সাঈদের মৃত্যুর ছবি ছড়িয়ে পড়ার পরই মূলত পুরো দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কেটে যায় সবার ভয়। আন্দোলন শক্তিশালী রূপ নেয়।
ড. ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরও দুই উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ, ছিলেন আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিদ আলমও।
প্রধান উপদেষ্টা সেখানে বলেন, মহাকাব্যের যে বীরগাথা, এই সেই বীরগাথা। এটা নিয়ে যুগে যুগে লেখালেখি হবে, স্মরণ করবে এই লোককে যে মাটির নিচে শুয়ে আছে। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
আবু সাঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “সে সারা জাতির জন্য, ন্যায়ের জন্য, মুক্তির জন্য বুক ফুলে দাঁড়িয়েছিল। ছবি দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে একটা মানুষ, একটা ছেলে হাত বাড়িয়ে দাঁড়ায়ে আছে..মারেন, গুলি করছে…একটু টলটল করছে, আবার দাঁড়াইছে। তারপর আবার গুলি।”
ড. ইউনূস বলেন, “এই সেই লোক… এটা শুধু পীরগঞ্জের বিষয় না, এটা বাংলাদেশের বিষয় না, সারা দুনিয়ার বিষয়। যে কাজটা সে করেছে, এটা নিয়ে যুগযুগান্তরে কবিতা হবে, উপন্যাস হবে, নাটক হবে। মানুষ স্মরণ করবে, সেই লোক এখানে শুয়ে আছে আজকে।”
আবু সাঈদের স্বপ্নকে এখন বাস্তবায়ন করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের কাজ হলো যে স্বপ্নের পেছনে দাঁড়িয়ে সে বুক পেতে দিয়েছিল সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা, এটা সারাজাতির একটা কর্তব্য। আমরা শুধু এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম, কবর জিয়ারত করলাম, তা না। এটা জাতিকে বলতে চাই, যে লক্ষ্য নিয়ে বুক পেতে দিয়েছিল, কোটি কোটি মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, ভয় পায় নাই। পথ দেখিয়ে গেছে, আমরা সে কারণে আজ নতুন বাংলাদেশ পেলাম। এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব এখন আমাদের। সেই কাজটা আমরা এখন করব।
সেইসঙ্গে আবু সাঈদ এখন আর কেবল তার নিজের ঘরের সন্তান নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, “এই আবু সাঈদ এখন এক পরিবারের সন্তান না, বাংলাদেশর যত পরিবার আছে, সবার সন্তান এবং তার দিকে সবাই তাকিয়ে থাকবে, ছোট ছেলে-মেয়ে যারা স্কুলে পড়বে, আবু সাঈদের কথা তারাও বলবে– আমি আবু সাঈদের জন্য লড়ব। আমিও ন্যায়ের জন্য লড়ব।”
তিনি বলেন, “আবু সাঈদ এখন ঘরে ঘরে। প্রত্যেক ঘরে আবু সাঈদ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সে এখন সবার সন্তান। এখানে হিন্দু পরিবার হোক, মুসলমান পরিবার হোক, বৌদ্ধ পরিবার হোক সবার ঘরের সন্তান এই আবু সাঈদ।
“কাজেই আপনারা খেয়াল রাখবেন, কোথাও যেন কোনও গোলযোগ না হয়, কেউ যেন ধর্ম নিয়ে কথা না বলে, আমরা সবাই এই মাটির সন্তান। আবু সাঈদ যেমন দাঁড়িয়েছে (বন্দুকের সামনে) আমরাও সেভাবে দাঁড়াব।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আবু সাঈদের মা সবার মা। তাকে রক্ষা করতে হবে। এটা এক বাংলাদেশ, আবু সাঈদের বাংলাদেশ, এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই। সবাই আবু সাঈদ। কাজেই সন্তানদের রক্ষা করা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে এটা এখন আমাদের কর্তব্য। আমরা যেন এটা নিশ্চিত করি। আমরা এখন সামনের পথে দাঁড়াই, আবু সাঈদ যেমন দাঁড়িয়েছিল, আমাদেরকেও এমন দাঁড়াতে হবে।”
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিতে গত ৮ আগস্ট ফ্রান্স থেকে দেশে ফেরার পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আবু সাঈদকে নিয়ে কথা বলেন ড. ইউনূস।
সেদিন তিনি বলেন, “আজকে আমার আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে, যে আবু সাঈদের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে।”
অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শনিবারই প্রথম ঢাকার বাইরে সফরে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।