আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তার শাসনামলে বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে দাসে পরিণত করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও অভিযোগ করেন, কোনও টাকা আত্মসাৎ না করলেও বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মিলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের দণ্ড দিয়েছিল।
কাকরাইলে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন আইন উপদেষ্টা।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতির বিচার হতোই না অভিযোগ করে আসিফ নজরুল বলেন, “দুর্নীতি যে একটা খারাপ জিনিস এটা ভাবার সংস্কৃতি আমাদের সমাজ থেকে চলে গিয়েছে।”
গত ১৫ বছরের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে ১০০ টাকার বালিশ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা দেখলাম ছয়টি ব্যাংক লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বড় লোকের একজন হয়ে গেছে।
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত এক লোক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আমরা দেখলাম একটা বেহায়া প্রধানমন্ত্রী; তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এটা হাসতে হাসতে জাতির সামনে বলছে।”
আড্ডায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে দুর্নীতির গল্প শুনেছেন দাবি করে আইন উপদেষ্টা বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় আড্ডায় শুনতাম শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার কে, শেখ রেহানার ক্যাশিয়ার কে? সালমান কার ক্যাশিয়ার, জয়ের টাকা কার মাধ্যমে যায়? পলক কার টাকা রাখে? আপনারা শুনতেন না?”
ওইসব দুর্নীতির বিচার করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন “দুদক ছিল, উচ্চ আদালত ছিল। কোনও বিচার হয়েছে? কিচ্ছু হয়নি। বিচার কার হতো? খালেদা জিয়ার বিচার।”
‘বিচার বিভাগ-দুদক মিলে খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেয়’
দুদকের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। পরে হাই কোর্ট এ সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এক আবেদনে সাজা স্থগিত করে মামলাটি শুনানি করছে আপিল বিভাগ।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে কোনও দুর্নীতি হয়নি, প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল দাবি করে বিচার বিভাগ ও দুদক মিলে খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় বলে অভিযোগ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা। এসময় শেখ হাসিনা ও তার পুরো পরিবারকে চোর হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “৩ কোটি টাকা এক জায়গায় রেখেছে, প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণে। একটা টাকাও সেখান থেকে আত্মসাৎ করেনি, মানে ভোগ করেনি। ৩ কোটি টাকা ব্যাংকে থেকে ৬ কোটি টাকা হয়েছে। ওই টাকা কেউ টাচ করেনি। সেজন্য তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ১০ বছরের জেল দিয়েছে; দুদক-বিচার বিভাগ মিলে।
“আর সেই চোর প্রধানমন্ত্রী, যার পুরো পরিবার ছিল চোর, সে সারাদেশে বলে বেড়াতো এতিমের টাকা নাকি খালেদা জিয়া আত্মসাৎ করেছেন। এই চোরের মুখের সামনে কেউ কথা বলতে পারতো না। দুদক তার দাসে পরিণত হয়েছিল, বিচার বিচার তার দাসে পরিণত হয়েছিল।”
‘১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি’
আওয়ামী লীগ আমলে চলতি বছরের শুরুর দিকে নিজের পরিবারের একটি ফ্ল্যাটের নামজারি করতে গেলে ভূমি নিবন্ধন কার্যালয় থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিল বলেও অভিযোগ করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, “সাত মাস আগে একটি ফ্ল্যাটের নামজারি করতে গিয়েছি। আমার মায়ের গয়না বেচার টাকা দিয়ে কম দামে ফ্ল্যাট কিনেছিল। সেই ফ্ল্যাটের নামজারি করতে গিয়েছি ১০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে। ওই ফ্ল্যাট নাকি আরেকজনের নামে নামজারি করে ফেলছে। ২০ বছর ধরে যে ফ্ল্যাটের আমরা ভাড়া পাই।”
তবে ওই ঘুষ নেওয়ার নির্দেশ অবশ্যই শেখ হাসিনা দিয়ে যাননি বলে মনে করেন নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “রাজনীতিবিদদের অবশ্যই আমরা দোষ দিব, সবাইকে দোষ দিব। কিন্তু এই দোষ দিয়ে অন্যায় থেকে যেন পার পাওয়ার চেষ্টা না করি। নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কি সৎ আছি? সব সময় কি বলপ্রয়োগের কারণে আমরা অসৎ হই? সব সময় কি আদেশ, নির্দেশের কারণে আমরা সৎ লোকের বিরুদ্ধে লাগি? অসৎ লোককে ছাড় দেই? প্রশ্নটা নিজেকে করি।”
‘পরিবেশ বদলেছে, তদন্তে প্রমাণ করুণ’
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেননি উল্লেখ করে সেই পরিবেশ বদলেছে জানিয়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান আইন উপদেষ্টা।
দুদক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “একটা দেশে এরকম পরিস্থিতিতে আপনারা অনেকেই কাজ করতে পারেন নাই- এমন এক্সকিউজ দিতে পারেন। তার মধ্যেও কেউ কেউ কাজ করার চেষ্টা করেছেন। এখন সেই পরিবেশ নাই।
“এখন কোনও উপদেষ্টা থেকে তদবির করেছে? কোনও উপদেষ্টা থেকে কেউ ফোন করেছে কোনোদিন? কেউ আপনাদের কোনোরকম হস্তক্ষেপ করছে না। এখন তদন্ত করেন, প্রমাণ করেন যে, ভালো পরিবেশ পেলে আপনারা ভালো কাজ করতে পারেন।”
মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন গত কমিশন পদত্যাগ করার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী মিলে শতাধিক ব্যক্তির দুনীতির অভিযোগ অনুসন্ধান অনুমোদন দেয়।
এ প্রসঙ্গ টেনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা বলেন, “গত আমলে চুরি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক যারা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার অ্যাপ্রোভাল দিয়ে গেছেন। এখন তদন্ত করেন, এখন কোনও সমস্যা হচ্ছে?
“তদন্ত করে দেখান যে, আপনাদের হৃদয় ওদের দ্বারা পলিউটেড হয়নি, ভালো পরিবেশ পেলে কাজ করতে পারেন। এটাই আপনাদের কাছে আমাদের ও সারাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা।”
‘উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন হচ্ছে’
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের আলোচনা থেকে বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা।
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি জানান, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন ও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে দুটি আলাদা আইনের খসড়া পাওয়া গেছে। এই দুটি আইন অবলম্বনে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইনটি যত দ্রুত সম্ভব করা হবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “যে সমস্ত কাজ বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সাহায্যে করা সম্ভব সেগুলো আমরা করে ফেলবো। আমরা দেরি করবো না, আমাদের খুব বেশি সময় নেই।”
তিনি বলেন, “বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন এখনও কোনও প্রতিবেদন দেয়নি। তবে আমি তাদের বললাম- উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আমরা একটা আইন করবো। আপনারা আইন করে দিতে পারবেন কি না। পরে ওই কমিশনের রিপোর্ট ছাড়াই আমাদের আইনটা (আইনের খসড়া) করে দিল। প্রধান বিচারপতিও একটা আইন করে দিয়েছেন। এ দুটি অবলম্বনে একটি আইন করা হবে।”
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরাল হয়ে ওঠে। এরপর থেকে ব্যাপক রদবদল দেখে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। এরপর সেই ধাক্কা আসে দুদকেও।
গত ২৯ অক্টোবর দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক এবং মোছা. আছিয়া খাতুন একসঙ্গে পদত্যাগ করেন।
এরপরই মূলত শূন্য হয়ে পড়ে এ তিনটি পদ। গত ১০ নভেম্বর দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার নিয়োগে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন করে সরকার।
দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ কত সময় লাগবে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “দুদকের ব্যাপারটা আমি দেখছি না। যারা দেখছেন বা যিনি দেখছেন তারা এ বিষয়ে সচেতন আছেন। দুদককে অচল রাখা যাবে না। এত বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে দুদককে অবশ্যই সচল করতে হবে।”
দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিব্রত : ইফতেখারুজ্জামান
অনুষ্ঠানে দুদক সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিযোগ করেন, দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা বিব্রতকর। এতদিন যা শুনেছেন তার চেয়ে হাজার গুণ দুর্নীতি হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “একদিকে দুদক দুর্নীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিজেরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে।
“আমরা গবেষণা ও সংবাদ মাধ্যমে এত দিন যা দেখে এসেছি, আজকে দুদক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেই ধরনের তথ্য পাচ্ছি সেটি অত্যন্ত বিব্রতকর, যা এতদিন জেনেছি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। অনিয়ম, অনাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি রয়েছে।”
দুদক সংস্কারে কার্যক্রম চলছে জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্থাটি ঢেলে সাজাতে সাঁড়াশি অভিযানের বিকল্প নেই।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা : গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে দুদকের আয়োজনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।