পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের পর নতুন করে আরও সম্পদের খোঁজে তৎপর দুদক।
এ অবস্থায় সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের দেশের বাইরে যেতে কোনও নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা হবে কি না—এ বিষয়ে সোমবার দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেই বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানকারী দল দেখছে। তারা সিদ্ধান্ত জানালে তবেই আদালতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করা হবে।
“প্রয়োজন মনে করলে আদালতে বেনজীরের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চাইবেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে সেটি তদন্ত সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে। এখনই এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হলে সব কিছু বিশদভাবে বলা যাবে।”
বেনজীরের ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী।
বেনজীরের আইনজীবী শাহ মনজরুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “(বেনজীরের) পরিবারের খরচ মেটাতে, ব্যবসা পরিচালনার জন্য মাননীয় আদালতের কাছে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করব। তবে … আবেদন করা হলে পরে জানাব।”
গোপালগঞ্জের সন্তান বেনজীর দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালে অবসরে যান। আইজিপির দায়িত্ব পালনের আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তারও আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বেনজীরের বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। তারপর বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে আদালতে আবেদনও হয়। এরপর দুদকও তৎপর হয়।
পরে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তালিকা জমা পড়ে আদালতে।
গত ২৩ ও ২৬ মে পৃথক দুইটি আদেশে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জারিন বিনতে বেনজীরের নামে বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির আংশিক শেয়ার জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকা মহানগরের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত।
আদেশের অনুলিপি থেকে জানা যায়, স্ত্রী সন্তানসহ সাবেক এই পুলিশ প্রধানের নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০২টা জমি ও ফ্ল্যাটের দলিল রয়েছে। এসব দলিলে জমি ও ফ্ল্যাটের মোট ক্রয়মূল্য লেখা রয়েছে ২৮ কোটি ৩০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটের মূল্য লেখা হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ১১৩টি দলিলের মূল্য লেখা হয়েছে ১০ কোটি ২১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। আর ৮৩টি দলিলে মূল্য লেখা হয়েছে ১৫ কোটি ৯০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
এছাড়া শিবচরে একটি দলিলে ৫ কাঠা জমি এবং ঢাকার সাভারের মৈস্তাপাড়া মৌজায় ৩ কাঠা জমির নাম রয়েছে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
স্ত্রী ও সন্তানদের নামে যেসব সম্পদ
বেনজীরের মালিকাধীন সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্ত্রী জিশান মীর্জার নামে গুলশানের তিনটি বিলাশবহুল ফ্ল্যাট, ছোট মেয়ে জাহরা জারিন বিনতে বেনজীরের নামে একটি ফ্ল্যাট।
এছাড়া সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, শান্তা সিকিউরিটিজে জিশান মীর্জার নামে থাকা বেনিফিশারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট, একই প্রতিষ্ঠানে মেয়ে তাহসীন রাইসা বীনতে বেনজীরের নামে থাকা বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
লংকা বাংলা সিকিউরিটিজে বেনজীর আহমেদের নামে থাকা বিও অ্যাকাউন্ট, সাভানা ন্যাচারাল পার্কের মালিকানা শেয়ার, সাভানা এগ্রো লিমিটেডের শেয়ার, সাভানা ইকো রিসোর্টের মালিকানা শেয়ার, ‘একটি শিশির বিন্দু’ লিমিটেডের পূর্ণ মালিকানা রয়েছে তাদের।
এছাড়া নর্থ চিকস রংপুর লি, নর্দার্ন বিজনেস অ্যাসোসিয়েটস, সেন্ট পিটার্স স্কুল অব লন্ডন, স্টেইলথ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেলটা আর্টিসান্স, ইস্ট ভ্যালি ডেইরি, গ্রিন মাল্টিমিডিয়া, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, কমিউনিটি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লি, সেন্ট্রার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ল’ অ্যানফোর্সমেন্ট রিসার্স ফাউন্ডেশন, পুলিশ ট্রাস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, পুলিশ ট্রাস্ট সার্ভিস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট, পুলিশ ট্রাস্ট কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং মেসার্স সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভে আংশিক মালিকানা শেয়ার রয়েছে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের।
জব্দ হয়েছে যেসব ব্যাংক হিসাব
সিটি ব্যাংকের বনানী, প্রগতি স্মরণি, গুলশান শাখায় তিনটি অ্যাকাউন্ট, সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড চারটি, কমিউনিটি ব্যাংকের করপোরেট শাখায় চারটি, আইএফআইসি ব্যাংকের উত্তরা শাখায় দুইটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক বনানী শাখায় একটি এবং গুলশান শাখায় দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংক গুলশান শাখায় দুইটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের দনিয়া ও বংশাল শাখায় দুটি, ইসলামী ব্যাংক কাকরাইলে ১টি, এবি ব্যাংক প্রধান শাখায় একটি, প্রাইম ব্যাংক মহাখালী শাখায় একটি, সোনালি ব্যাংক স্থানীয় শাখায় তিনটি, রমনা শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলা হয়েছে আদেশে।
এছাড়া পুঁজিবাজারে বিও অ্যাকাউন্ট ৯টি এবং পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে, সেগুলো জব্দ করতে বলা হয়েছে।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং আইন ২০১২ এর ১৪ ধারা এবং দুদক বিধিমালা ২০০৭ এর বিধি ১৮ অনুযায়ী সব স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজের আদেশ দেওয়া হলো। ক্রোক হওয়া সম্পত্তি হস্তান্তর করা যাবে না এবং জব্দকৃত ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দেওয়া গেলেও উত্তোলন করা যাবে না। সেই মর্মে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার, এসি ল্যান্ড বিএসইসি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দের নির্দেশনা চেয়ে নতুন করে আর কোনও আবেদন করা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, গত দুই দিনে ৮৩টি এবং ১১৯টি দলিল এবং ২৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ৯টি বিও অ্যাকাউন্ট এবং ৫টি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা শেয়ার ক্রোক ও জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এ পর্যন্তই আছে।