শিল্পকলা একাডেমির মূল ফটকের বাইরে একদল মানুষের বিক্ষোভের জের ধরে থেমে যায় অভ্যন্তরে মঞ্চে চলতে থাকা নাটক ‘নিত্যপুরাণ’।
মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত নাটকটির ১২৭তম শো চলছিল শনিবার। নাটকে দ্রৌপদীর চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেত্রী সুষমা সরকার। নাটকটির মাঝপথে তার প্রবেশ ঘটে মঞ্চে।
সেদিনও তিনি মঞ্চে উঠে তার নির্দিষ্ট চরিত্র অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গ্রিনরুমে । সেখানে তখন বাইরের বিক্ষোভের খবরটি এসে পৌঁছেছে। সবার চোখে মুখে দুঃশ্চিন্তা।
সকাল সন্ধ্যাকে সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে সুষমা সরকার বলেন, “আমরা শুনতে পাই, বাইরে বাবু ভাইকে (এহসানুল এজাজ বাবু) নিয়ে কিছু লোক বিক্ষোভ করছে। জামিল স্যার ঘটনাস্থলে আছেন। তাদের থামানোর চেষ্টা করছেন। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল। একটু নার্ভাসও হয়ে পড়েছিলাম। কারণ একটু পরেই ছিল আমার এন্ট্রি।”
তিনি জানান, নার্ভাসনেস নিয়েই তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন সেদিন। কেননা বাইরের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল গ্রিনরুমেও। তবে, দর্শক ভালো ছিল বলে সবারই মন ভালো ছিল। তাই, অভিনয়ে খুব একটা প্রভাব পড়ছিল না মঞ্চে। বেশ ক’জন নতুন সদস্যও সেদিন মঞ্চে নাটকটিতে অভিনয়ে অভিষেক ঘটেছিল।
“নিত্যপুরাণ নাটকটির ১২৭তম শো ছিল। যাকে এখন আমরা বলছি ১২৬.৫ তম শো। কেননা বাকিটা তো করা হয়নি। স্টেজে যখন আমি ডায়ালগ দিচ্ছিলাম, তখনই মঞ্চে হঠাৎ করে ঢুকে পড়েন জামিল স্যার ও আমাদের নাট্যকার নির্দেশক মাসুম রেজা। তারা দর্শকের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন। ঘটনা খুলে বলেন। আমি সেখানেই ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শো’টা মাঝপথে থেমে যাবে, ভাবতে পারিনি। তাও জামিল স্যার থাকতে।”
নাটক অর্ধসমাপ্ত রেখে নিরাপদে বাসায় ফিরে যান সুষমা সরকার। পরদিন শুটিং ব্যাগ গোছাতে হবে। নিত্যপুরাণ এর কস্টিউমগুলো গুছিয়ে নিতে গিয়েই তিনি থেমে গেলেন। সেই সময়ের অনুভূতির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তুলে ধরেছেন এ অভিনেত্রী-
“আমার অভিনয় জীবনে এই প্রথম কোন শো এমন মাঝপথে থেমে গেল। একজন অভিনেত্রী হিসেবে এই বেদনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। বাসায় ফিরে এই কস্টিউমের সামনে কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না।”
এ প্রসঙ্গে সকাল সন্ধ্যাকে সুষমা বলেন, “সে মুহূর্তে এতটাই খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল, এ পোশাক কি আর কখনও গায়ে জড়াতে পারব?”
এদিকে, নাটক বন্ধের পর বিবৃতি দিয়েছে দেশ নাটক। দলপ্রধান মাসুম রেজার স্বাক্ষরিত সে বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
গত ২ নভেম্বর, ২০২৪ দেশ নাটক প্রযোজনা- ১৫, নিত্যপুরাণ নাটকের ১২৭ তম প্রদর্শনী চলাকালে একদল লোকের মারমুখী অবস্থান ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাটকটির প্রদর্শনী মাঝ পথে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
দেশ নাটকের একজন সদস্যের ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তৈরি এই মব প্রথমে জাতীয় নাট্যশালার মূল গেটে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দর্শকদের হলে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। ব্যানারে তারা পোস্টদাতা সদস্যকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানায়। এমতাবস্থায় তারা দর্শকদের কাছ থেকে নাটকের টিকেট কেড়ে নেওয়া ও টিকেট কাউন্টারে হামলার মতো ঘটনা ঘটায়। নাট্যাঙ্গনের সিনিয়র সদস্যগণ কয়েকজন বিশৃঙ্খলাকারীর সাথে কথা বলেন এবং এক পর্যায়ে শিল্পকলার মহাপরিচালকও তাদের সাথে কথা বলেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে মহাপরিচালক আমাদের প্রদর্শনী শুরু করার পরামর্শ দেন।
নাটক যখন প্রায় শেষার্ধে তখন জানা যায় যে শিল্পকলার মূল গেটে পুনরায় মব সৃষ্টির চেষ্টা চলছে এবং শিল্পকলার গেটের তালা ভাঙ্গার তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। প্রদর্শনী বন্ধ না করলে তারা নাট্যশালায় আগুন লাগিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পকলার মহাপরিচালক পুনরায় উপস্থিত হয়ে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি মঞ্চে এসে প্রদর্শনী বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
এই ঘটনায় আমরা দেশ নাটক এর সদস্যরা অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে প্রদর্শনী বন্ধ করতে বাধ্য হই।
পরিস্থিতির শিকার দেশ নাটকের সকল সদস্য, আপামর দর্শকের কাছে এই অনভিপ্রেত ঘটনা ও নাটক বন্ধের জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছে। সেই সাথে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। মঞ্চ নাটকের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত হলো নাটক শেষে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করা। সেটি করতে না পারার কষ্ট আমাদেরকে কতদিন বহন করতে হবে আমরা জানি না। আশা করি এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে দর্শকসহ সকল সংস্কৃতিপ্রেমী ব্যক্তি ও সংগঠন আমাদের পাশে থাকবেন।