ভারতের অন্যতম ধনকুবের গৌতম আদানির প্রতিনিধি ও তার কোম্পানির কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল বিদেশে ঘুষ সংক্রান্ত এক মামলায় আদানির বিরুদ্ধে আনা ফৌজদারি অভিযোগ প্রত্যাহার। এই আলোচনায় সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র ব্লুমবার্গকে এমন তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রগুলো জানান, আলোচনা এই বছরের শুরুতে শুরু হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও নিবিড় হয়েছে। আলোচনার এই গতি বজায় থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যেই এর নিষ্পত্তি হতে পারে। তাদের মতে, আদানির প্রতিনিধিরা যুক্তি দিচ্ছেন যে, এই মামলাটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিগত অগ্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই মামলাটি পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন আদানি গ্রুপের একজন মুখপাত্র। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এবং হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকেও কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করার কয়েক দিনের মধ্যেই বাইডেন প্রশাসন গৌতম আদানি (৬২) ও তার ভাগ্নে সাগর আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রকাশ করে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একটি মামলা দায়ের করে।
প্রসিকিউটররা তখন দাবি করেন, গৌতম আদানি ভারতের আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি নিশ্চিত করতে পারেন। তবে আদানি গ্রুপ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনীর মর্যাদা পাওয়া গৌতম আদানি এরপর বিভিন্ন উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তার লক্ষ্য ছিল সাজা এড়ানো এবং এই অভিযোগের কারণে তার আন্তর্জাতিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া।
সূত্র আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই ধনকুবেরের পক্ষে কাজ করা কিছু প্রতিনিধি ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ট্রাম্পের সঙ্গে কীভাবে আলোচনা করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা যখন দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে আগ্রহী, ঠিক তখনই আদানি গ্রুপ এ থেকে সুবিধা নিতে চাইছে। অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে আদানি তার পক্ষে কাজ করার জন্য একদল প্রভাবশালী আইনজীবী ও লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। সূত্র জানায়, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের অংশ হিসেবে মার্চ মাসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ব্রুকলিনে ইউএস অ্যাটর্নি অফিসের প্রসিকিউটর ও প্রধান বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
ব্লুমবার্গ গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গৌতম আদানির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কের কথা প্রকাশ করে। সেই নেটওয়ার্ক এখনও ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় ‘কার্কল্যান্ড অ্যান্ড এলিস’ নামক আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মার্ক ফিলিপ আদানির পক্ষে প্রধান মুখ হিসেবে কাজ করছেন বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন।
আরও জানা গেছে, আদানি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা ‘বিজিআর গ্রুপ’ নামের একটি সরকারি সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিষ্ঠানকেও নিয়োগ দিয়েছেন।
সেনেটের লবিং সংক্রান্ত নথিপত্র অনুযায়ী, বিজিআর গ্রুপ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য আলোচনায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে।
তবে আদানির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা কাজ করছেন, তাদের কেউই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বা বার্তার উত্তর দেননি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পূর্বসূরিদের তুলনায় বিদেশে দুর্নীতির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৭৭ সালে পাস হওয়া ‘ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট’ বা এফসিপিএ আইন ব্যবহার করে পূর্ববর্তী প্রশাসনগুলো দেশি-বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে। কিন্তু ট্রাম্প বারবার অভিযোগ করেছেন যে, এসব মামলা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক নির্বাহী আদেশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে নির্দেশ দেন, তিনি যতদিন না পর্যন্ত নতুন নির্দেশিকা জারি করেন, ততদিন যেন এফসিপিএভিত্তিক সব মামলা স্থগিত রাখা হয়। সেই সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, “এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার জন্য আরও বেশি ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে।”
এরপর থেকে কয়েকটি এফসিপিএ মামলা বাতিল করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, কগনিজ্যান্ট টেকনোলজি সলিউশনস করপোরেশনের সাবেক নির্বাহীদের বিরুদ্ধে এক বিদেশি ঘুষ মামলার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বিচার বিভাগ।
ঐ সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ভারতে একটি নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য তারা বিদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছিলেন। তবে অভিযুক্তরা বরাবরই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আসছিলেন এবং তাদের বিচার নিউ জার্সিতে হওয়ার কথা ছিল।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি পদক্ষেপ— নিউ ইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত— রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অনেক অভিজ্ঞ প্রসিকিউটর পদত্যাগ করেন।
পরবর্তীকালে একজন ফেডারেল বিচারক প্রশাসনকে অ্যাডামসের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র প্রত্যাহার করতে দেন। তবে তিনি অভিযোগগুলো ‘উইথ প্রেজুডিস‘ ভিত্তিতে বাতিল করেন। এর অর্থ হলো, প্রশাসন ভবিষ্যতে আর একই অভিযোগে মামলা করতে পারবে না। এর মাধ্যমে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হলেও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে যায়। মেয়র অ্যাডামস বরাবরই নিজেকে নির্দোষ বলে আসছেন।
ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা
গৌতম আদানির সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার হলেও, যুক্তরাষ্ট্রে তার ব্যবসায়িক উপস্থিতি এখনও তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তবুও গত নভেম্বরে নির্বাচনের পরপরই এবং বিচার বিভাগের অভিযোগ প্রকাশের কয়েক দিন আগেই, আদানি সোশাল মিডিয়া এক্সে ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানান। তিনি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এবং প্রায় ১৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন।
বিচার বিভাগ আদানির বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে একটি সিলমোহরযুক্ত আদালত নথিতে অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগে বলা হয়, তিনি সিকিউরিটিজ প্রতারণা এবং সিকিউরিটিজ ও ওয়্যার ফ্রড ষড়যন্ত্র করেছেন।
তবে বিচার বিভাগ ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অভিযোগে ‘ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট’ বা এফসিপিএ আইন উল্লেখ করেনি। বরং অভিযোগে বলা হয়েছে, আদানি মিথ্যাভাবে দাবি করেছেন তার কোম্পানি ঘুষবিরোধী আইন পুরোপুরি মেনে চলছে। আর এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঋণদাতাদের বিভ্রান্ত করেছেন।
এখন ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম অনেকটাই নীরব, তবুও এসইসি তাদের মামলার অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। গত সপ্তাহে জমা দেওয়া এক নথিতে এসইসি জানিয়েছে, তারা ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাইছে, যাতে অভিযোগ ও সমন আদানির কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
আদানি ফৌজদারি মামলাটি নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হলে এবং শুধু এসইসির মামলাটি সক্রিয় থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে তার বিরুদ্ধে ঝুঁকির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
আদানি ট্রাম্প প্রশাসনকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তা এখন ওয়াশিংটনে একটি সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে। বর্তমানে অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি ও দণ্ডপ্রাপ্তরা ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি বা তার মিত্রদের মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন— তদন্ত বন্ধ, অভিযোগ প্রত্যাহার বা সাজা বাতিলের আশায়।
ইতোমধ্যেই আদানির পক্ষ নিয়েছেন কয়েকজন কংগ্রেসনাল রিপাবলিকান। তাদের একটি দল অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডির কাছে আবেদন করেছেন, যাতে ফৌজদারি মামলা বাতিল করা হয় এবং তদন্ত করা হয়— কেন প্রথমে এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।
এদিকে আদানির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা বিভিন্ন পক্ষও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তারা তার ব্যবসায়িক স্বার্থ অগ্রসর করার চেষ্টাও করছেন। মার্ক ফিলিপ ও হোয়াইট-কলার অপরাধে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী উইলিয়াম বার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন করেছেন আদানির কোম্পানিগুলোর পক্ষে লবিং করার জন্য।
তথ্যসূত্র : ব্লুমবার্গ



