গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
সংশোধিত আইনে বিশেষায়িত এই ব্যাংকে সরকারি মালিকানা কমিয়ে এর গ্রাহকদের মালিকানা বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে শহর এলাকায়ও গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম চালানোর সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি অনুমোদন পায়।
বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো সংবাদ সম্মেলনে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সংসদ না থাকায় এখন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংশোধিত আইন কার্যকর হবে।
ড. ইউনূসের উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতায় এইচ এর এরশাদের সামরিক শাসনামলে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
সাধারণ ব্যাংকের চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করবে বলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বাইরে স্বতন্ত্র একটি আইনের বলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ছিলেন। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য প্রশমন করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখায় ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস যৌথভাবে শািন্ততে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল।
গ্রামীণ ব্যাংক আইনে দেখা যায়, ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটিতে শুরুতে সরকারের অংশ ছিল ২৫ শতাংশ, ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের অংশ ছিল ৭৫ শতাংশ।
মাঝে হেরফের হলেও ড. ইউনূসকে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকছাড়া করার পর ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে সরকার ও ঋণ গ্রহীতাদের মালিকানার অনুপাত শুরু মতো করে।
গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন সেখানে সংশোধন আনল।
সংবাদ সম্মেলনে রিজওয়ানা গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন নিয়ে বলার সময় আওয়ামী লীগ আমলে ড. ইউনূসকে হেনস্তার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক একটা মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করত, সেটা হলো যারা গ্রামীণ ব্যাংকের বেনিফিশিয়ারি (ঋণগ্রহীতা), তাদের একটি সেট থাকবে এই ব্যাংকটি পরিচালনায়।
“আপনারা জানেন, এখন যিনি আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদক, উনাকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের যে দর্শন ছিল, যে মালিকানা যে বেনিফিশিয়ারিদের হাতে থাকবে, সেখান থেকে মালিকানা অনেকটা সরকারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।”
এখন গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন করে ঋণগ্রহীতাদের মালিকানা বাড়ানোর কথা জানিয়ে রিজওয়ানা বলেন, “পরিশোধিত মূলধন আগে ছিল সরকার ২৫ পারসেন্ট, আর যারা বেনিফিশিয়ারি তারা ৭৫ পারসেন্ট। এখন হয়ে গেছে ১০ পারসেন্ট ও ৯০ পারসেন্ট।”
গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরুর সময় এর মালিকানার অনুপাত নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না ড. ইউনূস। তা নিয়ে তৎকালীন (১৯৮৩ সালে) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা ২০০৩ সালে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ড. ইউনূস।
এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক আইনের আরও কিছু বিষয় নিয়েও আপত্তি ছিল এই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দ্রষ্টা ড. ইউনূসের।
যেমন গ্রামীণ ব্যাংক এখন শুধু গ্রামীণ পর্যায়েই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালাতে পারে। এখন আইন সংশোধন করে শহরাঞ্চলেও কাজের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
রিজওয়ানা বলেন, “আজকে যে গ্রামীণ ব্যাংক শুধু ভূমিহীনদের নিয়ে কাজ করত, এখন বিত্তহীনদের একটি সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পরিসর থেকে বেরিয়ে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
বাংলাদেশের ৯৪ শতাংশ গ্রামে রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ। এর ঋণগ্রহীতা সদস্য এক কোটির বেশি, যাদের ৯৭ শতাংশই নারী। এদের দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন বলে গ্রামীণ ব্যাংকের দাবি।
গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় সরকারের কর্তৃত্ব নিয়েও অসন্তুষ্ট ছিলেন ড. ইউনূস, যা তিনি বিভিন্ন সময় প্রকাশও করেন।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ সরকারের মনোনীত তিনজন পরিচালক এবং ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত নয়জন পরিচালক ছিলেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রয়েছে।
সেখানে সংশোধন আনার কথা জানিয়ে রিজওয়ানা বলেন, “বোর্ডের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যারা এর বেনিফিশিয়ারি তদের মধ্য থেকে নয়জন নির্বাচিত হয়ে আসবে। এই নয়জনের মধ্য থেকে আবার তিনজন মনোনীত হবে। তাদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবে।”
গ্রামীণ ব্যাংককে এখন থেকে ‘জনস্বার্থ সংস্থা’ হিসাবে বিবেচনা করার বিধানও যোগ করা হয়েছে বলে জানান উপদেষ্টা রিজওয়ানা।