রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটা মনে আছে? আফগানিস্তানের কাবুল থেকে রহমত শেখ কলকাতায় এসেছিলেন ফল বিক্রি করতে। ছোট্ট মিনির সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক ছুঁয়ে যায় সবাইকে।
আফগান ক্রিকেটও তাই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশ, যেখানে খেলার মাঠের পাশেই বোমা ফাটে, ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত অনুশীলনের ব্যবস্থা নেই-সেই তারা এখন ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। রশিদ খান, মোহাম্মদ নবি, গুলবাদিন নাইব, মুজিব উর রহমান, রহমানউল্লাহ গুরবাজরা খেলেন বিশ্বের প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে।
নিজের দেশে যে সুবিধার অভাব, সেটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে খেলে পূরণ করে একেকজন হয়ে উঠেছেন মহাতারকা। সব তারকা একসঙ্গে জ্বলে উঠলে যেমন মহাবিশ্বে তৈরি হয় মায়াবী দৃশ্য, ক্রিকেটেও তাই হলো। কল্পনাকে হার মানিয়ে আফগানিস্তান প্রথমবার পৌঁছে গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে।
তাদের সাফল্যটা একেবারে অকল্পনীয়ও নয়। ব্রায়ান লারার মতো কিংবদন্তি বুঝতে পেরেছিলেন, এবার সেমিফাইনাল খেলতে পারে রশিদ খানের দল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে পিটিআইয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একমাত্র তিনিই সেমির ফেবারিট হিসেবে নিয়েছিলেন আফগানদের নাম।
আজ বাংলাদেশকে হারিয়ে তাই লারার প্রতি রশিদ খানের কৃতজ্ঞতা, ‘‘আমরা সেমিফাইনাল খেলতে পারি, এটা একমাত্র বলেছিলেন লারা। সেই কথা সত্যি প্রমাণ করলাম। এখানে একটা ওয়েলকাম পার্টিতে দেখা হয়েছিল লারার সঙ্গে। বলেছিলাম, তার কথা ভুল হতে দেব না।’’
গত ওয়ানডে বিশ্বকাপেই সেমিফাইনালের দ্বারপ্রান্তে ছিল আফগানিস্তান। চোট নিয়ে একপায়ে অবিশ্বাস্য ডাবল সেঞ্চুরিতে স্বপ্নটা পূরণ করতে দেননি অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। এবার সেই অস্ট্রেলিয়াকে পেছনে ফেলে শেষ চারে আফগানিস্তান। বাংলাদেশকে হারানোর পর পুরো আফগানিস্তান পরিণত হয়েছে উৎসবের দেশে। আফগান ক্রিকেট বোর্ড ‘এক্স’-এ পোস্ট করেছে জালালাবাদ শহরের একটি ছবি। যেখানে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে জয়ধ্বনি তুলেছেন রশিদদের নামে।
অথচ ১০-১৫ বছর আগেও গোটা আফগানিস্তানে কোনো ঘাসের মাঠ ছিল না। মোহাম্মদ নবিরা বেড়ে উঠেছেন সিমেন্টের উইকেটে খেলে। টেপ টেনিসে ভালো খেলা ক্রিকেটারদের এনে পরিচর্যা করে তৈরি করেছেন বোর্ড কর্তারা। ধীরে ধীরে ৩৪ প্রদেশের দেশটির ৩২টি প্রদেশে প্রাদেশিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে সফল হয়েছে বোর্ড। তাতে উন্নতিটা হচ্ছে দ্রুত।
তাদের কোচিং স্টাফে তারার মেলা নেই। প্রধান কোচ জোনাথন ট্রট, বোলিং কোচ ডোয়াইন ব্রাভো আর ফিল্ডিং কোচ হিসেবে রয়েছেন শেন ম্যাকডারমট। অথচ একটা সময় বাংলাদেশেরই ফিল্ডিং কোচ ছিলেন ম্যাকডারমট। বাংলাদেশ তার কার্যকারিতার মূল্য না দিলেও দিয়েছে আফগানরা।
ট্রটও নামি কোনও কোচ নন, তবে আজ বৃষ্টিতে যখন ডিএলএসে আফগানরা এগিয়ে তখন ঠিকই ড্রেসিংরুম থেকে বার্তা দিয়েছেন খেলাটার গতি কমানোর! সেটা মানতে গিয়ে হাস্যকরভাবে গড়িয়ে পরে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন গুলবাদিন নাইব। সে যাই হোক, জেতার জন্য এই যে হৃদয় উজার করে জীবন বাজি রেখে খেলা, সেটারই প্রশংসা করছেন সবাই।
তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তানের তারকা অনেক ক্রিকেটার থাকেন দেশের বাইরে। এজন্য কোনও সিরিজের আগে ক্যাম্প পর্যন্ত করা যায় না। আফগানিস্তানে খেলতে যায় না কোনও বিদেশি দল। কখনও ভারতের নয়ডা তো কখনও দেরাদুনকে হোম ভেন্যু করে খেলতে হয় দ্বিপক্ষীয় ‘হোম সিরিজ’।
সেই আফগানিস্তান বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পৌঁছানোয় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার, মোহাম্মদ কাইফ, উমর গুলরা। ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম জাফর এক্সে লিখেছেন, ‘‘একটা সময় অস্ট্রেলিয়া ১০ বছর পরপর আমন্ত্রণ জানাত ভারতকে। ইংল্যান্ড টেস্ট খেলাত মৌসুমের শুরুতে। একই বোর্ডগুলো এখন লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানায় ভারতকে। আফগানিস্তানের সঙ্গেও একই জিনিস হবে। ওরা যে শ্রদ্ধা দাবি করে ক্রিকেট বিশ্ব সেটা দিবে আফগানদের।’’
সেই অপেক্ষাতেই রশিদ খানদের দল। তারা যে সেমিফাইনালে পৌঁছতে পারেন সেই আত্মবিশ্বাস গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পেয়েছিল বলে জানালেন রশিদ খান, ‘‘আমরা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে যে ভাবে শুরু করেছিলাম তাতেই আত্মবিশ্বাস পেয়ে যাই। এটা অবিশ্বাস্য।’’
আফগানিস্তানের ইনিংসের শেষ ওভারে রশিদ খান তৃতীয় বলে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করিম জানাত এক রানের বেশি নেননি। রাগে তার দিকে ব্যাট ছুড়ে দিয়ে নন-স্ট্রাইকারের দিকে ফিরে যান রশিদ।
পরে ব্যাট নিতে এসেও প্রকাশ করেন ক্ষোভ। এটা আসলে দলকে কয়েকটা বেশি রান এনে দেওয়ার তাড়নায়। তবে সেমিফাইনালে আর কোনও চাপ নিতে চান না রশিদ খান, ‘‘সহজভাবে সেমিফাইনালটা খেলতে চাই। উপভোগ করতে চাই।প্রতিটা মুহূর্ত।’’
আফগানিস্তান ক্রিকেটের তো এখন উপভোগ করারই সময়।