Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

তালেবান শাসনে কেমন আছে আফগান নারীরা

তালেবান শাসনে নারীদের কেন করে থাকতে হবে, তা দেখানো হয়েছে এই পোস্টাারে। ছবি : গার্ডিয়ান
তালেবান শাসনে নারীদের কেমন করে থাকতে হবে, তা দেখানো হয়েছে এই পোস্টাারে। ছবি : গার্ডিয়ান
[publishpress_authors_box]

মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তা যেন একটু শান্তিতে হয়, সেই আশায় এখন আফগান নারীরা। কারণ তালেবান শাসনে দেশটির নারীদের এখন নাভিঃশ্বাস ওঠার অবস্থা।

২০২১ সালে তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরে। এরপর থেকে চলছে নারীদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ। স্কুল বন্ধ করে দেওয়া, ঘরের বাইরে বের না হতে না দেওয়া এমন নানা কিছু।

বর্তমান তালেবান আমলের আগে আফগান নারীরা নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রশ্নে যতটুকু এগিয়েছিল, এখন গত তিন বছরের বেশি সময়ে পিছিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক। তবে সব গল্পই যে হতাশার তা নয়। এরই মধ্যে আছে প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের গল্প। হাতের মেহেদি কিংবা তুষারপাতের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে খেলা করার মতো খুবই সাধারণ ঘটনাগুলো যুক্ত হয়েছে প্রতিবাদের ভাষায়।

জন্মদিনে ঘরের ভেতরে নাচ, গৃহবন্দি আফগান কিশোরীদের এটাই হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। ছবি : গার্ডিয়ান

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে আফগান নারীদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন সাংবাদিক মেলিসা কর্নে। তার সঙ্গী ছিলেন আলোকচিত্রী কিয়ানা হায়েরি। তারা দুজন কয়েক বছর আফগানিস্তানে কাটিয়েছেন। এমনকি তালেবানরা ক্ষমতায় ফেরার পরেও তারা অনেকদিন ছিলেন দেশটিতে।

এসময় তাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের ৭ প্রদেশের শতাধিক নারী ও কিশোরীর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়। তাদের কথোপকথনে উঠে এসেছে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের চিত্র। তবে সেই সঙ্গে হতাশাও স্পষ্ট। গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা যেভাবে তালেবানের কঠোর বিধি-নিষেধের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়েছে, তা সাক্ষী তারা।

আফগান নারীদের মাত্র তিন বছরের মধ্যে প্রায় সব ধরনের সামাজিক জীবন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র এমনকি পার্ক ও গণস্নানাগারও তাদের জন্য নিষিদ্ধ।

তালেবানের জন্মস্থান ও রাজনৈতিক কেন্দ্র কান্দাহার থেকে দলটির নেতারা নির্দেশ দিয়েছেন, নারীদের জনসমক্ষে মুখ ঢেকে রাখতে হবে, সবসময় একজন পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে থাকতে হবে এবং জনসমক্ষে তাদের কণ্ঠ শোনা যাবে না।

তবে বিদেশি নারী হিসাবে চলাচলের ক্ষেত্রে হায়েরি ও কর্নের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের ১ কোটি ৪০ লাখ নারী ও কিশোরীর জন্য এই স্বাধীনতার কথা ভাবাই যায় না। তবু এরই মধ্যে নিরাপত্তার ঝুঁকির মতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে আফগান নারীদের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে তাদের।

পশ্চিম কাবুলে একটি দোকানের ভেতরে গোপনে পাঠরত এক কিশোরী। ছবি : গার্ডিয়ান

দেশটির একেক প্রদেশে নারীদের ওপর নিপীড়নের বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকার নারীরা তালেবানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই বেশ সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করত। তাদের অনেকে বলেছেন, এখন আর তাদের সহিংসতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

তবে অন্য অনেক জায়গার পরিস্থিতি ভয়াবহ।

আফগান মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণে তালেবানের নিষেধাজ্ঞাকে সবচেয়ে কঠোর আঘাত হিসেবে দেখছেন অনেকে।

তালেবান ক্ষমতায় ফেরার কয়েক মাস আগে একটি স্কুলে আত্মঘাতী হামলার শিকার হন ১৭ বছর বয়সী গুলসম। তার এখন আর হাঁটার ক্ষমতা নেই। হুইলচেয়ারই তার ভরসা। কিন্তু তবুও পড়ালেখা করার অদম্য ইচ্ছা থেকে গুলসম একটি গোপন স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করেন। বোমা হামলায় আহত হওয়া ও তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পড়ালেখা ও কঠোর পরিশ্রমের রোখ বেড়ে যায় তার।

তবে তার ১৪ বছর বয়সী ছোট বোন মনে হয় আশা হারিয়ে ফেলেছে। সে দুই বছরেরও বেশি সময়ে মাত্র কয়েকবার ঘর থেকে বের হতে পেরেছে।

গুলসমের ভাষ্যে, “২০২১ সালে আমার ছোট বোন স্কুলে গিয়েছিল। সেদিন স্কুল খোলার কথা ছিল। কিন্তু সে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফেরে। কারণ ছাত্রীদের ছত্রভঙ্গ করতে তালেবানরা গুলি ছুড়েছিল। ছাত্রীরা স্কুল কবে খোলা হবে তা জানতে চাওয়ায় দুই জন মেয়েকে পিটিয়েছিল তালেবানরা। ছাত্রীদের ঘর থেকে বের না হতে সতর্ক করেও দেয় তারা। এরপর থেকে আমার ছোট বোন গভীর বিষণ্নতায় ডুবে গেছে।”

“সে সব সময় আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এত পড়াশোনা করে কী লাভ? শেষে তো মরতেই হবে।’ আমি পরিশ্রম করব, মরব। তুমি পরিশ্রম করবে, তুমিও মরবে। আমি শান্তিতে মরতে চাই,” বলেন গুলসম।

ঘর থেকে বের হতে চাইলে আফগান নারীদের এভাবে বোরকায় নিজেদের আবৃত করতে হয়। ছবি : গার্ডিয়ান

বহু আফগান মেয়ে এখন আর ঘরে বসে পড়ালেখা করার তাগিদ পায় না। কারণ পড়ালেখার ক্ষেত্রে স্কুল খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সেই স্কুলই বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। ফলে ওই মেয়েরা এখন আর নিজেদের জন্য আলাদা করে কোনও ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। এসময় অনেক মেয়ে ও নারীকে অর্থনৈতিক বাজে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।

এমনই এক মেয়ে ১৪ বছর বয়সী মরিয়ম। অর্থনৈতিক কষ্টে তার পরিবার একটি পানির কূপ ও সৌর প্যানেলের বিনিময়ে তাকে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়।

২০২৩ সালে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়া অনথিভুক্ত শরণার্থীদের মধ্যে একটি হলো মরিয়মের পরিবার। পর্যাপ্ত নথি না থাকায় পাকিস্তান পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দেয়। এখন তাদের নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

মরিয়মের ভাষ্যে, “আমি পাকিস্তানে একটি মাদ্রাসায় পড়তাম। কিন্তু এখানে যেতে পারি না। আমি পড়ালেখায় ভালো। আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার সংবাদে আমরা খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু আমি পাকিস্তানেই থাকতে চাই। কারণ সেখানে অন্তত আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারব।”

গার্দি গোশের মতো কিছু জেলায় এখনও মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে। ছবি : গার্ডিয়ান

জাবুল ও কাবুলের একাধিক হাসপাতালে গেছেন হায়েরি ও কর্নে। সেখানে তারা অপুষ্টিতে ভোগা আফগান নারীদের ও তাদের পরিবারের দুর্দশা দেখতে পান।

আড়াই বছর বয়সী ফাতিমার ওজন মাত্র ৫ কেজি। তার পরিবারের কাছে খাবার কেনার পর্যাপ্ত টাকা নেই। এজন্য প্রায়ই হাসপাতালের অপুষ্টি বিভাগে ফাতিমাকে ভর্তি করাতে হয়।

লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে মেয়েদের অপুষ্টির সমস্যা আরও বাড়ছে। কাবুলের কয়েকটি হাসপাতালের নার্সদের মতে, তাদের অনেক মেয়ে শিশুকে চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। কারণ খাদ্য সংকটের সময় আফগান পরিবারগুলো মেয়েদের তুলনায় ছেলে সন্তানদের খাওয়ানোকে প্রাধান্য দেয়।

তবে হায়েরি ও কর্নে শুধু দুর্দশাগ্রস্ত আফগান নারীদের গল্প তুলে ধরতে চাননি। পাশাপাশি তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে ওই নারীদের শক্তিশালী অবস্থান ও প্রতিরোধের গল্পও তারা তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে আছে গোপন শিক্ষা নেটওয়ার্ক, অনানুষ্ঠানিক সভার আয়োজনের মতো ঘটনা।

তুষারপাতের মধ্যে বাইরে বের হয়ে খেলা করা, জন্মদিন পালন কিংবা হাতে মেহেদি দেওয়ার মতো সাধারণ বিষয়গুলোও আফগান নারীদের কাছে আজ প্রতিরোধের সমান। এসব কার্যকলাপ আপাতদৃষ্টে ছোট মনে হয়। কিন্তু এগুলো তালেবানের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের ভাষা।

আফগান নারীদের ঠিকানা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে গৃহকোণে। ছবি : গার্ডিয়ান

জাহুরা তেমনই একজন নারী, যিনি তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেছেন। তালেবান আমলে রাস্তায় প্রতিবাদ করতে না পেরে তিনি অনলাইনে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করেন। হিজাব পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হয় সেসব অভূতপূর্ব প্রতিবাদ।

হায়েরিকে জাহুরা বলেন, “পাঁচ থেকে দশজন নারী এই ভিডিওগুলো তৈরি করেন। এরপর সেগুলো আমরা মিডিয়ায় পাঠিয়ে আমাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরি।”

তবে জাহুরাও একদিন হতাশ হয়ে পড়েন। তালেবানদের থেকে নিজেকে রক্ষায় অনেক কষ্টে পাড়ি জমান বিদেশে।

যাবার আগে জাহুরা বলে যান, “এখন বুঝি, এখানে থাকার কোনও উপায় নেই। আমি আমার সময় ও জীবন নষ্ট করব। কোনও উন্নতি সম্ভব নয়। এখানে আমি মানবিক হতে পারি না। এখানে কিছুই নেই।”

আফগানিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে নারীপ্রতি প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু তালেবান কমান্ডার অবশ্য অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রাখেন। এতে গোপন স্কুলগুলো চলতে সমস্যা হয় না। এমনটি নারীরা একা রাস্তায় বের হওয়ার মতো ঘটনাগুলো সহজ হয়েছে। তবে তাদের স্বাধীনতা এখনও ক্ষমতাধর পুরুষের সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত