মৌসুমী ওরফে এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট। জন্মের পর মাত্র কয়েকমাস পেয়েছিলেন জন্মদাত্রীর কোল। তারপর ঠাঁই হলো এতিমখানায়, আর সেখান থেকে সোজা ইউরোপের দেশ নরওয়ে।
এরপর পেরিয়েছে ৪৮ বছর। নিজে চার সন্তানের মা হয়েছেন। আর মা হওয়ার পরই গর্ভধারিনীকে খুঁজে পাওয়ার, ছুঁয়ে দেখার তাড়না সৃষ্টি হয় এলিজাবেথের মনে। সেই থেকে মাকে খুঁজে চলেছেন। ২০১৩ সালেও একবার বাংলাদেশে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন।
তবে এবার আর হতাশ হতে হয়নি মৌসুমী ওরফে এলিজাবেথকে। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মার চর গ্রামে গিয়ে পেয়েছেন মায়ের দেখা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সত্যিই জড়িয়ে ধরতে পেরেছেন মাকে, নিতে পেরেছেন তার শরীরের ঘ্রাণ।
বৃহস্পতিবার সকালে পদ্মার চর গ্রামের মানুষ দেখলেন ৪৮ বছর পর মা-মেয়ের মিলনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী এলিজাবেথের জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ জুলাই। এর পাঁচ মাসের মাথায় ২২ ডিসেম্বর ঢাকার একটি এতিমখানা থেকে তাকে দত্তক নিয়ে যায় নরওয়ের এক দম্পতি। সেই থেকে এলিজাবেথ নরওয়ের বাসিন্দা। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জানতেনই না যে, কে তার আসল বাবা-মা।
দত্তক দেওয়ার আগে এলিজাবেথের নাম ছিল মৌসুমী, প্রথম পাসপোর্টেও তাই লেখা ছিল। নরওয়ের চিকিৎসক রয় রয়েড ও ক্যারেন রয়েড দম্পতি দত্তর নেওয়ার পর নাম রাখেন এলিজাবেথ ফিরোজা রয়েড। বিয়ের পর রয়েড বদলে হন ফাজালসেট, ফিরোজা নামটি এসেছিল জন্মদাত্রীর নাম থেকে।
দত্তকের দলিলপত্র অনুযায়ী, এলিজাবেথের প্রকৃত মায়ের নাম ফিরোজা বেগম, বাবা মৃত বশির সরদার। জন্ম হয়েছিল ঢাকা শহরে।
আগের বার বাংলাদেশে এসে মাকে খুঁজে না পেয়েও হাল ছাড়েননি এলিজাবেথ। এবার দেশে আসার পর সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে যান তিনি।
এলিজাবেথ জানান, সেখানে গিয়ে দত্তক পাঠানোর কাগজপত্র খুঁজে পান তিনি। সেই কাগজপত্রেই পান মায়ের ঠিকানা। আজ সেই ঠিকানা অনুযায়ী মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মার চর গ্রামে গিয়ে মায়ের দেখা পান তিনি।
বাংলাদেশে এলিজাবেথের সঙ্গে রয়েছেন বন্ধু ক্রিস্টোফার সরকার। তার কাছ থেকে জানা গেল আরও বিস্তারিত।
সকাল সন্ধ্যাকে ক্রিস্টোফার বলেন, “এতদিন পর আজ সকালে মা-মেয়ের দেখা হলে সেখানে আবেগঘন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা-মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। বিকাল পর্যন্ত মায়ের সঙ্গেই ছিলেন এলিজাবেথ। এরপর তিনি ঢাকার পথে রওয়ানা হন।
“কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি আবার নরওয়ে ফিরে যাবেন। এরপর আবার আসবেন। ভবিষ্যতে মাকেও নরওয়েতে বেড়াতে নিয়ে যেতে চান এলিজাবেথ।”
কোথায় ছিলেন মা
মৌসুমী কিংবা এলিজাবেথের মা ফিরোজা বেগমের বাড়ি মাদারীপুর। তাকে খুঁজে পাওয়ার পর জানা গেল পেছনের সব ঘটনা।
ফিরোজা বেগম মেয়েকে জানিয়েছেন, তিনি যখন পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা তখন স্বামী বশির সরদারের মৃত্যু হয়। সেসময় ফিরোজার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর অসহায় কিশোরী মা ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেই জন্ম দেন মৌসুমী ওরফে এলিজাবেথের। তবে সন্তান জন্মের পর ওই আত্মীয় মা-মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
তখন নবজাতক সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন কিশোরী ফিরোজা। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের পরামর্শে শিশু সন্তানটিকে রেখে আসেন এতিমখানায়। এরপর আর সন্তানের কোনও খোঁজ জানতেন না ফিরোজা। এতিমখানা থেকে যে নরওয়েতে দত্তক দেওয়া হয়েছে, সেটিও ছিল তার কাছে অজানা।
ক্রিস্টোফার সরকার বলেন, “প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আরও দুজনকে বিয়ে করেছিলেন ফিরোজা। দ্বিতীয় স্বামীও মারা গেছেন। তবে কোনও ঘরেই আর সন্তান হয়নি ফিরোজার। সেই হিসেবে এলিজাবেথের আর কোনও ভাইবোনও নেই। এতদিন ধরে অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজের জীবন চালিয়েছেন ফিরোজা বেগম।”
এত বছর পর নিজের মেয়েকে দেখে দারুণ খুশি ফিরোজা বেগম। বললেন, মেয়েকে এতিখানায় দেওয়ার পর আর কখনোই দেখতে পাননি। কিন্তু মেয়েকে ভুলতে পারেননি তিনি। সবসময় নিজের মেয়ের ভালোর জন্য দোয়া করতেন।
ফিরোজা বলেন, “এখন মেয়েকে পেয়েছি। জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার।”
পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী এলিজাবেথ ফিরোজা ফাজালসেট বাস করেন নরওয়ের আরেন্ডাল শহরে। স্বামীর নাম হেনরিক ফাজালসেট। এই দম্পতির চার সন্তান, কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছেন বড় ছেলে থিও।
আপাতদৃষ্টিতে সুখী আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটালেও এলিজাবেথের মনে শান্তি ছিল না। তার মানসিক অশান্তির কারণ ছিল, নিজের সঠিক পরিচয় না জানা। এলিজাবেথ জানতেন না কোন পরিবারে, কার গর্ভে জন্ম হয়েছিল তার।
মাকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি নিয়ে বাংলাদেশে আসার খবর ‘শেকড়ের খোঁজে এবার নরওয়ে থেকে আসছেন এলিজাবেথ’ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছিল সকাল সন্ধ্যায়।
সেসময় তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “আমি নরওয়েতে খুব চমৎকার একটি পরিবারে বড় হয়েছি, এখন আমার নিজেরও একটি পরিবার আছে।
“সবকিছু থাকার পরও আমি এক ধরনের অজানা আকাঙ্ক্ষা অনুভব করছি। নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। তাই যেভাবেই হোক আমি আমার পরিবারের খোঁজ জানতে চাই। বাবা তো আগেই মারা গেছেন, বাকি যারা আছেন তাদের সান্নিধ্য পেতে চাই।”
অবশেষে মনের সেই আশা পূরণ হয়েছে এলিজাবেথের, ৪৮ বছরের পর ফিরে পেয়েছেন মায়ের কোল।